প্রাক-স্বাধীনতা যুগে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বহুবিধ ধারার সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন গুরুকুল ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় মক্তব-মাদ্রাসা পর্যন্ত ভারতীয় শিক্ষার একটি নিজস্ব ঐতিহ্য ছিল, যা মূলত ধর্ম ও দর্শনকেন্দ্রিক। অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই শিক্ষা ব্যবস্থায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এই পর্বে তিনটি প্রধান শক্তি ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছিল: ব্রিটিশ সরকার, খ্রিস্টান মিশনারিরা এবং ভারতীয় সমাজ সংস্কারকগণ। এদের মধ্যে খ্রিস্টান মিশনারিদের অবদান, বিশেষত শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে, ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। আর এই মিশনারি কার্যকলাপের ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল নামটি হলো শ্রীরামপুর মিশন।
শ্রীরামপুর মিশনের কার্যকলাপ শুধুমাত্র ধর্মপ্রচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি ছিল একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যা বাংলার শিক্ষা, সমাজ ও সাহিত্যে এক নবজাগরণের পথ প্রশস্ত করেছিল। উইলিয়াম কেরি, যশুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়াম ওয়ার্ড—এই ত্রয়ীর নেতৃত্বে শ্রীরামপুর মিশন যে কাজ শুরু করেছিল, তা ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক হিসেবে আজও স্বীকৃত। এই প্রবন্ধে আমরা শ্রীরামপুর মিশনের শিক্ষাবিস্তারের বিভিন্ন দিক এবং তার প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
১৭৯৩ সালে ব্যাপটিস্ট মিশনারি সোসাইটির প্রতিনিধি হিসেবে উইলিয়াম কেরি (William Carey) বাংলায় আসেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্টধর্ম প্রচার করা। কিন্তু তৎকালীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে মিশনারিদের ধর্মপ্রচারের কার্যকলাপকে সন্দেহের চোখে দেখত। কোম্পানির শাসনাধীন এলাকায় ধর্মপ্রচারের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকায় কেরি ও তাঁর সহযোগীরা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন।
এই পরিস্থিতিতে, ১৭৯৯ সালে কেরি তাঁর সহযোগী যশুয়া মার্শম্যান (Joshua Marshman) এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড (William Ward)-কে নিয়ে কলকাতার অদূরে দিনেমার (ডেনিশ) উপনিবেশ শ্রীরামপুরে আশ্রয় নেন। দিনেমার শাসকরা মিশনারিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, তাই তাঁরা এখানে নির্বিঘ্নে তাঁদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান। ১৮০০ সালের ১০ই জানুয়ারি এই তিন মনীষী একত্রে শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও আদর্শের জন্য ইতিহাসে তাঁরা ‘শ্রীরামপুর ত্রয়ী’ (Serampore Trio) নামে পরিচিত।
তাঁদের কাজের মূল ভিত্তি ছিল শিক্ষা। তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে না দিতে পারলে ধর্মপ্রচার বা সমাজ সংস্কার—কোনোটিই সফল হবে না। এই উপলব্ধি থেকেই তাঁরা এক व्यापक শিক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, যা ভারতের আধুনিক শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
শ্রীরামপুর মিশনের শিক্ষাদর্শ ছিল সমকালীন প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত আধুনিক ও বৈপ্লবিক। তাঁদের মূল উদ্দেশ্যগুলি ছিল নিম্নরূপ:
১. গণশিক্ষার প্রসার: তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষা কেবল উচ্চবিত্ত বা উচ্চবর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের কাছে, বিশেষত দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া ছিল তাঁদের প্রধান লক্ষ্য।
২. মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা: সেই সময়ে শিক্ষার মাধ্যম ছিল মূলত সংস্কৃত, আরবি বা ফারসি। কিন্তু শ্রীরামপুর ত্রয়ী উপলব্ধি করেন যে, সাধারণ মানুষ যদি তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ করতে না পারে, তবে প্রকৃত জ্ঞানার্জন সম্ভব নয়। তাই তাঁরা বাংলা ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন।
৩. নারীশিক্ষার প্রবর্তন: উনিশ শতকের গোড়ার দিকে সমাজে নারীশিক্ষা ছিল প্রায় অকল্পনীয়। শ্রীরামপুর মিশনই প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভারতের নারীশিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ করে, যা ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
৪. আধুনিক ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার: শুধুমাত্র পুঁথিগত শিক্ষার পরিবর্তে তাঁরা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, কৃষি, এবং অন্যান্য বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর জোর দেন, যাতে মানুষ স্বনির্ভর হতে পারে।
৫. সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংস্কার: শিক্ষার মাধ্যমে তাঁরা সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার, যেমন—সতীদাহ প্রথা, জাতিভেদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
শ্রীরামপুর মিশনের অবদানকে কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ভাগ করে আলোচনা করলে তার গুরুত্ব বোঝা সহজ হবে।
১. গণশিক্ষা ও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা:
কেরি এবং তাঁর সহযোগীরা উপলব্ধি করেছিলেন যে, শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হলে একটি সুসংগঠিত বিদ্যালয় ব্যবস্থা প্রয়োজন। তাঁরা শ্রীরামপুর এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে একের পর এক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেন। ১৮০০ সালেই তাঁরা প্রথম অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তাঁদের প্রচেষ্টায় ১৮১৮ সালের মধ্যে প্রায় ১০৬টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০,০০০। এই বিদ্যালয়গুলিতে বাংলা, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল এবং নীতিশিক্ষার মতো বিষয়গুলি পড়ানো হতো। এই বিদ্যালয়গুলির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল যে, এখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শিশুকে বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়া হতো। এটি ছিল ভারতে মিশনারি শিক্ষা প্রসারের এক প্রত্যক্ষ ও সফল উদাহরণ।
২. নারীশিক্ষার সূচনা:
শ্রীরামপুর মিশনের সবচেয়ে বৈপ্লবিক অবদান হলো নারীশিক্ষার প্রবর্তন। যশুয়া মার্শম্যানের স্ত্রী হানা মার্শম্যান (Hannah Marshman) এই ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৮০০ সালে তিনি শ্রীরামপুরে বালিকাদের জন্য প্রথম বিদ্যালয় স্থাপন করেন। প্রথমদিকে ছাত্রীসংখ্যা কম থাকলেও, তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে ধীরে ধীরে সমাজে নারীশিক্ষার গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে। ১৮২৪ সালের মধ্যে তাঁদের অধীনে প্রায় ২৬টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়, যেখানে প্রায় ৫০০-র বেশি ছাত্রী পড়াশোনা করত। রক্ষণশীল সমাজে এই উদ্যোগ ছিল এক দুঃসাহসিক পদক্ষেপ এবং এটিই পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর ও অন্যান্য সমাজ সংস্কারকদের নারীশিক্ষার আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করেছিল।
৩. মুদ্রণশিল্পের প্রসার ও পাঠ্যপুস্তকের জোগান:
শিক্ষাবিস্তারের পথে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল পর্যাপ্ত পাঠ্যপুস্তকের অভাব। এই সমস্যা দূর করার জন্য উইলিয়াম ওয়ার্ডের নেতৃত্বে শ্রীরামপুর মিশন ১৮০০ সালে একটি ছাপাখানা বা মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করে। এটি বাংলা মুদ্রণশিল্পের ইতিহাসে এক মাইলফলক। এই ছাপাখানা থেকে শুধুমাত্র বাইবেলের অনুবাদই নয়, বরং বাংলা ভাষায় লেখা বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক, যেমন—ব্যাকরণ, অভিধান, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি ছাপানো শুরু হয়। এর ফলে স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্যে বই সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়। এই মুদ্রণযন্ত্রের হাত ধরেই বাংলা অক্ষর বা টাইপোগ্রাফির বিকাশ ঘটে এবং বাংলা গদ্য সাহিত্য এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। ১৮১৮ সালের মধ্যে এই ছাপাখানা থেকে প্রায় ৪০টি ভাষায় বই মুদ্রিত হয়েছিল।
৪. বাংলা গদ্যের বিকাশ ও ভাষাচর্চা:
উইলিয়াম কেরিকে প্রায়শই ‘বাংলা গদ্যের জনক’ বলা হয়। যদিও এই উপাধি বিতর্কিত, কিন্তু বাংলা গদ্যের বিকাশে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি প্রথম বাংলা ভাষায় ব্যাকরণ রচনা করেন (‘A Grammar of the Bengali Language’, 1801) এবং একটি দ্বিভাষিক অভিধান (‘A Dictionary of the Bengali Language’) সংকলন করেন। এছাড়াও, তাঁর লেখা ‘কথোপকথন’ (১৮০১) এবং ‘ইতিহাসমালা’ (১৮১২) বাংলা গদ্যকে একটি সরল, প্রাঞ্জল ও কার্যকরী রূপ দিয়েছিল। এই বইগুলি শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক হিসেবেই ব্যবহৃত হয়নি, বরং বাংলা গদ্যের প্রাথমিক শৈলী গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কেরি ও তাঁর সহযোগীরা বাইবেলকে বাংলাসহ প্রায় ৩৪টি ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করেন, যা বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার গঠন ও শব্দভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছিল।
৫. উচ্চশিক্ষার প্রসার: শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা:
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার প্রসারেও শ্রীরামপুর মিশন এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। ১৮১৮ সালে তাঁরা শ্রীরামপুর কলেজ (Serampore College) প্রতিষ্ঠা করেন। এই কলেজটি ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জ্ঞানচর্চার এক মেলবন্ধন। এখানে ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি আধুনিক বিষয় পড়ানো হতো।
শ্রীরামপুর কলেজের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি আসে ১৮২৭ সালে, যখন ডেনমার্কের রাজা ষষ্ঠ ফ্রেডারিক একটি রাজকীয় সনদ বা রয়্যাল চার্টারের মাধ্যমে এই কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় বা ডিগ্রি প্রদানের মর্যাদা দেন। এটিই ছিল এশিয়ার প্রথম প্রতিষ্ঠান যা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি লাভ করে। এই মর্যাদা লাভের ফলে শ্রীরামপুর কলেজ স্বাধীনভাবে কলা (Arts) ও ধর্মতত্ত্ব (Theology) বিষয়ে ডিগ্রি প্রদান করার অধিকার পায়। আজও এই কলেজ সেই ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
৬. সাংবাদিকতার প্রসার:
শিক্ষার প্রসারে সংবাদপত্রের ভূমিকা উপলব্ধি করে শ্রীরামপুর মিশন বাংলা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে। ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষার প্রথম মাসিক পত্রিকা ‘দিগদর্শন’। এর কিছুদিন পরেই, ২৩শে মে, ১৮১৮ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’। এই সংবাদপত্রটিতে দেশ-বিদেশের খবরের পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন আলোচনা, সামাজিক সমস্যা এবং সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হতো। ‘সমাচার দর্পণ’ সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তথ্যের প্রসারে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
শ্রীরামপুর মিশনের অবদান নিয়ে আলোচনা করলে তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক—উভয় দিকই বিবেচনা করা প্রয়োজন।
ইতিবাচক দিক:
সমালোচনামূলক দিক:
সমস্ত সমালোচনা সত্ত্বেও, প্রাক-স্বাধীনতা যুগে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাসে শ্রীরামপুর মিশনের অবদানকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। তাঁদের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, ফলস্বরূপ বাংলা তথা ভারতের শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতি এক নতুন পথের সন্ধান পেয়েছিল। শ্রীরামপুর ত্রয়ী যে প্রদীপ জ্বেলেছিলেন, তারই আলোকে পরবর্তীকালে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডিরোজিওর মতো মনীষীরা বাংলার নবজাগরণের মশালকে এগিয়ে নিয়ে যান।
গণশিক্ষার প্রসার, মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, নারীশিক্ষার সূচনা, মুদ্রণশিল্পের প্রবর্তন এবং উচ্চশিক্ষার ভিত্তি স্থাপন—এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই শ্রীরামপুর মিশন ছিল অগ্রদূত। তাঁদের কাজ শুধুমাত্র কয়েকটি বিদ্যালয় বা একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি ছিল একটি সামগ্রিক আন্দোলন যা একটি ঘুমন্ত সমাজকে জাগিয়ে তুলেছিল এবং আধুনিক ভারতের পথে যাত্রার সূচনা করেছিল। তাই, শিক্ষার ইতিহাসে শ্রীরামপুর ত্রয়ী-র নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
প্রশ্ন ১: “শ্রীরামপুর ত্রয়ী” নামে কারা পরিচিত ছিলেন?
উত্তর: “শ্রীরামপুর ত্রয়ী” নামে পরিচিত ছিলেন তিনজন ব্যাপটিস্ট মিশনারি— উইলিয়াম কেরি, যশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড। তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই শ্রীরামপুর মিশন পরিচালিত হতো।
প্রশ্ন ২: শ্রীরামপুর মিশন কবে এবং কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?
উত্তর: শ্রীরামপুর মিশন ১৮০০ সালের ১০ই জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করা। তবে মিশনারিরা উপলব্ধি করেছিলেন যে, শিক্ষার বিস্তার ছাড়া ধর্মপ্রচার বা সমাজ সংস্কার সম্ভব নয়, তাই শিক্ষাবিস্তার তাঁদের কার্যকলাপের প্রধান অংশ হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন ৩: শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানার ভূমিকা কী ছিল?
উত্তর: শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানা শিক্ষাবিস্তারে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছিল। এর মাধ্যমে বাংলা ভাষায় প্রথম পাঠ্যপুস্তক, ব্যাকরণ, অভিধান ইত্যাদি স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্যে ছাপিয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়। এটি বাংলা মুদ্রণশিল্পের ভিত্তি স্থাপন করে এবং শিক্ষার উপকরণ সহজলভ্য করে তোলে।
প্রশ্ন ৪: বাংলা গদ্যের বিকাশে উইলিয়াম কেরির দুটি প্রধান অবদান উল্লেখ করুন।
উত্তর: বাংলা গদ্যের বিকাশে উইলিয়াম কেরির দুটি প্রধান অবদান হলো:
১. তিনি বাংলা ভাষার প্রথম முறাবদ্ধ ব্যাকরণ রচনা করেন, যার নাম ‘A Grammar of the Bengali Language’ (১৮০১)।
২. তিনি ‘A Dictionary of the Bengali Language’ নামে একটি সমৃদ্ধ বাংলা-ইংরেজি অভিধান সংকলন করেন, যা বাংলা শব্দভান্ডারকে স্থিতিশীল রূপ দেয়।
প্রশ্ন ৫: শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রকাশিত প্রথম বাংলা সংবাদপত্রটির নাম কী এবং এটি কবে প্রকাশিত হয়?
উত্তর: শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রকাশিত প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক সংবাদপত্রটির নাম হলো ‘সমাচার দর্পণ’। এটি ১৮১৮ সালের ২৩শে মে প্রথম প্রকাশিত হয়।
প্রশ্ন ৬: ভারতে নারীশিক্ষা প্রসারে শ্রীরামপুর মিশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি কী ছিল?
উত্তর: ভারতে নারীশিক্ষা প্রসারে শ্রীরামপুর মিশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বালিকাদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন। হানা মার্শম্যানের (যশুয়া মার্শম্যানের স্ত্রী) নেতৃত্বে তাঁরা প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা রক্ষণশীল সমাজে নারীশিক্ষার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল এবং পরবর্তী সমাজ সংস্কারকদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
প্রশ্ন ৭: শ্রীরামপুর কলেজের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কী?
উত্তর: শ্রীরামপুর কলেজের ঐতিহাসিক গুরুত্ব হলো, এটি এশিয়ার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা বিশ্ববিদ্যালয় বা ডিগ্রি প্রদানের মর্যাদা লাভ করে। ১৮২৭ সালে ডেনমার্কের রাজা ষষ্ঠ ফ্রেডারিক একটি রাজকীয় সনদের মাধ্যমে এই কলেজকে স্বাধীনভাবে কলা ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে ডিগ্রি প্রদানের অধিকার দেন, যা ছিল তৎকালীন ভারতে উচ্চশিক্ষার ইতিহাসে এক মাইলফলক।
প্রশ্ন ৮: শ্রীরামপুর মিশনের শিক্ষামূলক কার্যকলাপের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল বলে সমালোচকরা মনে করেন?
উত্তর: সমালোচকদের মতে, শ্রীরামপুর মিশনের শিক্ষামূলক কার্যকলাপের মূল বা প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্টধর্ম প্রচার করা। তাঁরা শিক্ষাকে ধর্মপ্রচারের একটি কার্যকরী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন, যার প্রমাণ মেলে তাঁদের পাঠ্যপুস্তকে খ্রিস্টীয় ভাবধারার প্রাধান্যে।
প্রশ্ন ৯: মিশনারিরা ব্রিটিশ শাসিত এলাকা ছেড়ে শ্রীরামপুরে কেন কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন?
উত্তর: তৎকালীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে মিশনারিদের ধর্মপ্রচারের কার্যকলাপের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। সেই নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে নির্বিঘ্নে কাজ করার জন্য তাঁরা পার্শ্ববর্তী দিনেমার (ডেনিশ) উপনিবেশ শ্রীরামপুরে কেন্দ্র স্থাপন করেন, কারণ সেখানকার শাসকরা মিশনারিদের প্রতি অনেক বেশি সহনশীল ছিলেন।
প্রশ্ন ১০: গণশিক্ষার প্রসারে শ্রীরামপুর মিশন যে ধরনের বিদ্যালয় স্থাপন করেছিল তার দুটি বৈশিষ্ট্য লিখুন।
উত্তর: গণশিক্ষার প্রসারে শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলির দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো:
১. এই বিদ্যালয়গুলিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শিশুকে শিক্ষা দেওয়া হতো, যা শিক্ষার গণতন্ত্রীকরণে সাহায্য করেছিল।
২. শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সংস্কৃত বা ফারসির পরিবর্তে মাতৃভাষা বাংলাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, যাতে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা সহজে জ্ঞানার্জন করতে পারে।
প্রাক-স্বাধীনতা যুগে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় শ্রীরামপুর মিশনের অবদান অনস্বীকার্য। এই মক টেস্টের মাধ্যমে উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান ও ওয়ার্ডের যুগান্তকারী কার্যকলাপ সম্পর্কে আপনার জ্ঞান যাচাই করুন এবং নিজের প্রস্তুতিকে আরও শক্তিশালী করে তুলুন।
নির্দেশাবলী: