Core Concepts of Spearman’s Two-Factor Theory স্পিয়ারম্যানের দ্বি-উপাদান তত্ত্বের মূল ধারণা
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, যখন মনোবিজ্ঞান একটি পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করছিল, তখন বুদ্ধিমত্তাকে বৈজ্ঞানিকভাবে পরিমাপ করার এবং এর গঠন বোঝার একটি নতুন ধারার সূচনা হয়। এই ধারাটি Psychometric Approach বা মনস্তাত্ত্বিক পরিমাপ পদ্ধতি নামে পরিচিত। এই পদ্ধতির মূল লক্ষ্য ছিল পরিসংখ্যানগত কৌশল ব্যবহার করে মানসিক ক্ষমতার গঠন বিশ্লেষণ করা। এই সাইকোমেট্রিক ধারার অন্যতম পথিকৃৎ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন ব্রিটিশ মনোবিজ্ঞানী Charles Spearman।
স্পিয়ারম্যানই প্রথম বুদ্ধিমত্তার গঠন নিয়ে একটি সুসংহত এবং পরিসংখ্যানগতভাবে সমর্থিত তত্ত্ব প্রদান করেন, যা দ্বি-উপাদান তত্ত্ব’ বা ‘Two-Factor Theory’ নামে পরিচিত। এই তত্ত্বে তিনি প্রস্তাব করেন যে মানুষের সমস্ত বৌদ্ধিক কার্যকলাপের পিছনে দুটি মৌলিক উপাদান কাজ করে: একটি সাধারণ উপাদান (‘g’ factor) এবং কিছু বিশেষ উপাদান (‘s’ factors)। তাঁর এই তত্ত্ব কেবল বুদ্ধিমত্তার আলোচনাকেই নতুন दिशा দেয়নি, বরং মনোবিজ্ঞানে Factor Analysis নামক একটি শক্তিশালী পরিসংখ্যানগত পদ্ধতিরও সূচনা করেছিল।
১৯০৪ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধে (“General Intelligence, Objectively Determined and Measured”) স্পিয়ারম্যান তাঁর দ্বি-উপাদান তত্ত্বটি উপস্থাপন করেন। তাঁর মতে, যেকোনো বৌদ্ধিক কাজের পারদর্শিতা দুটি উপাদানের উপর নির্ভর করে
- সাধারণ উপাদান (General Factor) বা ‘g’ Factor
বিশেষ উপাদান (Specific Factor) বা ‘s’ Factor
সাধারণ উপাদান (‘g’ Factor): The General Mental Energy
- বৈশিষ্ট্য:
স্পিয়ারম্যানের তত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দু হলো এই ‘g’ ফ্যাক্টর। তাঁর মতে, এটি একটি সাধারণ মানসিক শক্তি (General Mental Energy) যা সমস্ত ধরনের বৌদ্ধিক কার্যকলাপের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
- সর্বজনীন (Universal): ‘g’ ফ্যাক্টরটি সমস্ত বৌদ্ধিক কাজের মধ্যে সাধারণ। অর্থাৎ, আপনি গণিত করুন, কবিতা লিখুন, বা ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্যার সমাধান করুন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই সাধারণ মানসিক শক্তির প্রয়োজন হবে। স্পিয়ারম্যান একে একটি পাওয়ার প্ল্যান্টের সাথে তুলনা করেছেন, যা শহরের বিভিন্ন বাড়িতে (বিশেষ কাজ) বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। পাওয়ার প্ল্যান্টের ক্ষমতা যত বেশি হবে, সব বাড়ি তত ভালোভাবে আলো পাবে।
- সহজাত (Innate): স্পিয়ারম্যান বিশ্বাস করতেন যে ‘g’ ফ্যাক্টর মূলত বংশগতি দ্বারা নির্ধারিত এবং জন্মগত। এটিকে প্রশিক্ষণ বা শিক্ষার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা যায় না। একজন ব্যক্তির মধ্যে ‘g’ ফ্যাক্টরের পরিমাণ প্রায় স্থির থাকে।
- পরিমাণে ভিন্নতা (Varies among individuals): বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে ‘g’ ফ্যাক্টরের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন হয়। যাদের মধ্যে ‘g’ ফ্যাক্টরের পরিমাণ বেশি, তারা সামগ্রিকভাবে বেশি বুদ্ধিমান হন এবং বিভিন্ন বৌদ্ধিক কাজে ভালো পারফর্ম করার সম্ভাবনা রাখেন। যাদের ‘g’ ফ্যাক্টর কম, তারা তুলনামূলকভাবে কম বুদ্ধিমান হন।
- কর্মক্ষমতার নির্ধারক (Determinant of Performance): যেকোনো বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষায় একজন ব্যক্তির স্কোর মূলত তার ‘g’ ফ্যাক্টরের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। এটিই বুদ্ধিমত্তার প্রধান এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
বিশেষ উপাদান (‘s’ Factor): The Specific Abilities
- বৈশিষ্ট্য:
- ক্ষেত্র-নির্দিষ্ট (Domain-Specific): ‘s’ ফ্যাক্টরগুলো কোনো একটি নির্দিষ্ট কাজের জন্য প্রযোজ্য। যেমন, গণিতের জন্য একটি নির্দিষ্ট ‘s’ ফ্যাক্টর (s-mathematical) প্রয়োজন, যা সঙ্গীতের জন্য প্রয়োজনীয় ‘s’ ফ্যাক্টর (s-musical) থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
- অর্জিত (Acquired): ‘g’ ফ্যাক্টরের বিপরীতে, ‘s’ ফ্যাক্টরগুলো শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জন ও উন্নত করা যায়। একজন ব্যক্তি অনুশীলনের মাধ্যমে তার গাণিতিক দক্ষতা (mathematical s-factor) বা সঙ্গীত প্রতিভা (musical s-factor) বাড়াতে পারেন।
- স্বাধীন (Independent): বিভিন্ন ‘s’ ফ্যাক্টর একে অপরের থেকে স্বাধীন। অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি গণিতে খুব ভালো (উচ্চ s-factor) হলেও সঙ্গীতে দুর্বল (নিম্ন s-factor) হতে পারেন। একটি ক্ষেত্রের বিশেষ দক্ষতা অন্য ক্ষেত্রের দক্ষতার পূর্বাভাস দেয় না।
- সংখ্যায় একাধিক (Numerous): পৃথিবীতে যত ধরনের বৌদ্ধিক কাজ আছে, তত ধরনের ‘s’ ফ্যাক্টর থাকতে পারে। যেমন:
- s(v): ভাষাগত দক্ষতা (Verbal ability)
- s(m): গাণিতিক দক্ষতা (Mathematical ability)
- s(sp): স্থানিক বা দৈশিক দক্ষতা (Spatial ability)
- s(mech): যান্ত্রিক দক্ষতা (Mechanical ability)
- s(mu): सांगितিক দক্ষতা (Musical ability)
‘g’ এবং ‘s’ ফ্যাক্টরের মধ্যে সম্পর্ক (Relationship between ‘g’ and ‘s’ Factors)
স্পিয়ারম্যানের তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনো নির্দিষ্ট বৌদ্ধিক কাজে একজন ব্যক্তির পারফরম্যান্স তার ‘g’ ফ্যাক্টর এবং ওই কাজের সাথে সম্পর্কিত ‘s’ ফ্যাক্টরের যোগফলের সমান।
সূত্র: Performance (P) = g + s
- উদাহরণ: ধরুন, একজন ছাত্রকে একটি জ্যামিতির সমস্যা সমাধান করতে দেওয়া হলো। তার এই কাজটি করার ক্ষমতা নির্ভর করবে:
- তার সাধারণ বুদ্ধিমত্তা বা ‘g’ ফ্যাক্টরের উপর (যা তাকে সমস্যাটি বুঝতে, যুক্তি প্রয়োগ করতে সাহায্য করবে)।
- তার স্থানিক বা জ্যামিতিক দক্ষতার ‘s’ ফ্যাক্টরের উপর (যা তাকে জ্যামিতিক আকার কল্পনা করতে এবং স্থানিক সম্পর্ক বুঝতে সাহায্য করবে)।
যদি তার ‘g’ ফ্যাক্টর উচ্চ হয়, সে যেকোনো নতুন সমস্যা দ্রুত বুঝতে পারবে। আর যদি তার জ্যামিতির ‘s’ ফ্যাক্টরও অনুশীলনের মাধ্যমে উন্নত হয়, তাহলে সে খুব সহজেই সমস্যাটির সমাধান করতে পারবে।
- উদাহরণ: ধরুন, একজন ছাত্রকে একটি জ্যামিতির সমস্যা সমাধান করতে দেওয়া হলো। তার এই কাজটি করার ক্ষমতা নির্ভর করবে:
স্পিয়ারম্যানের তত্ত্বের গুরুত্ব ও প্রভাব (Importance and Impact of Spearman’s Theory)
১. ফ্যাক্টর অ্যানালাইসিসের প্রবর্তন:
তাঁর সবচেয়ে स्थायी অবদান হলো ফ্যাক্টর অ্যানালাইসিসকে মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় একটি অপরিহার্য হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। আজ কেবল বুদ্ধিমত্তা নয়, ব্যক্তিত্ব (personality), মনোভাব (attitude) এবং অন্যান্য অনেক মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য অধ্যয়নের জন্য এই পদ্ধতি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
২. ‘g’ ফ্যাক্টরের ধারণার স্থায়িত্ব:
যদিও বুদ্ধিমত্তার বহু-উপাদান তত্ত্বগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে, ‘g’ ফ্যাক্টরের ধারণাটি আজও মনোবিজ্ঞানে অত্যন্ত প্রভাবশালী। আধুনিক আইকিউ (IQ) পরীক্ষাগুলো, যেমন ওয়েক্সলার স্কেল (Wechsler Scales) বা স্ট্যানফোর্ড-বিনেট টেস্ট (Stanford-Binet Test), এখনও একটি সামগ্রিক আইকিউ স্কোর প্রদান করে, যা স্পিয়ারম্যানের ‘g’ ফ্যাক্টরের ধারণার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। বহু গবেষণায় দেখা গেছে যে ‘g’ ফ্যাক্টর अकादमिक সাফল্য, চাকরির পারফরম্যান্স এবং জীবনের নানা ক্ষেত্রের সাফল্যের একটি নির্ভরযোগ্য পূর্বাভাসক (predictor)।
৩. পরবর্তী তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন:
স্পিয়ারম্যানের কাজ পরবর্তী প্রজন্মের মনোবিদদের জন্য একটি ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে। তাঁর তত্ত্বের সমালোচনা থেকেই থার্স্টোন, ক্যাটেল এবং ভার্ননের মতো গবেষকরা আরও উন্নত এবং জটিল হায়ারার্কিকাল মডেল তৈরি করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এককথায়, তিনি বুদ্ধিমত্তার বৈজ্ঞানিক আলোচনার দরজা খুলে দিয়েছিলেন।
৪. ব্যবহারিক প্রয়োগ (Practical Implications):
শিক্ষাগত এবং পেশাগত ক্ষেত্রেও এর প্রভাব রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং নিয়োগকর্তারা প্রায়শই সাধারণ জ্ঞানীয় ক্ষমতা (general cognitive ability) পরিমাপের জন্য পরীক্ষা ব্যবহার করেন, যা স্পিয়ারম্যানের ‘g’ ফ্যাক্টরের ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি।
চার্লস স্পিয়ারম্যানের দ্বি-উপাদান তত্ত্ব ছিল বুদ্ধিমত্তার গঠন নিয়ে প্রথম বৈজ্ঞানিক এবং পরিসংখ্যানগতভাবে সমর্থিত একটি মডেল। তিনি প্রস্তাব করেন যে মানুষের প্রতিটি বৌদ্ধিক কাজের পিছনে একটি সাধারণ, জন্মগত মানসিক শক্তি (‘g’ ফ্যাক্টর) এবং একটি অর্জিত, ক্ষেত্র-নির্দিষ্ট দক্ষতা (‘s’ ফ্যাক্টর) কাজ করে। তাঁর ফ্যাক্টর অ্যানালাইসিস পদ্ধতির প্রয়োগ মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় এক নতুন যুগের সূচনা করে।
যদিও তাঁর তত্ত্বটি বুদ্ধিমত্তার জটিলতাকে কিছুটা সরল করে দেখে এবং জ্ঞানীয় প্রক্রিয়াগুলোকে উপেক্ষা করে, এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ‘g’ ফ্যাক্টরের ধারণাটি আজও বুদ্ধিমত্তা গবেষণার একটি কেন্দ্রীয় বিষয় এবং তাঁর কাজ পরবর্তী সমস্ত তত্ত্বের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেছে। স্পিয়ারম্যানের তত্ত্ব আমাদের শিখিয়েছে যে, বুদ্ধিমত্তার মতো একটি জটিল মানসিক গঠনকেও বৈজ্ঞানিক কঠোরতা এবং পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে বোঝা সম্ভব। তাই, মনোবিজ্ঞানের ইতিহাসে তিনি একজন চিরস্মরণীয় পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত হন।