পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠক্রমের মূল্যায়ন: পাঠক্রমের নীতি, সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী, স্বাধীনতা ও শৃঙ্খলা
শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড। কোনো দেশের বা রাজ্যের ভবিষ্যৎ তার শিক্ষা ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। শিক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে তার পাঠক্রম (Curriculum)। পাঠক্রম শুধুমাত্র কয়েকটি বিষয়ের সমষ্টি নয়, এটি একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা যা শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশে সহায়তা করে। এটি সেই পথনির্দেশিকা, যা অনুসরণ করে একটি প্রজন্ম আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত হয়। পশ্চিমবঙ্গ, যা একসময় ভারতের সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক রাজধানী হিসাবে পরিচিত ছিল, তার শিক্ষা ব্যবস্থার দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ (WBBSE) দ্বারা পরিচালিত মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ (WBCHSE) দ্বারা পরিচালিত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা—এই দুটি স্তর রাজ্যের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত্তি স্থাপন করে।
এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য হলো পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পাঠক্রমের একটি গভীর এবং সমালোচনামূলক মূল্যায়ন করা। এই মূল্যায়নটি চারটি প্রধান স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে করা হবে:
১. পাঠক্রমের নীতি (Principles of Curriculum): একটি আদর্শ পাঠক্রমের কী কী নীতি থাকা উচিত এবং পশ্চিমবঙ্গের পাঠক্রম সেই নীতিগুলি কতটা অনুসরণ করতে সক্ষম হয়েছে?
২. সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী (Co-curricular Activities): শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। রাজ্যের পাঠক্রমে এই কার্যাবলীগুলির অবস্থান এবং কার্যকারিতা কতটা?
৩. স্বাধীনতা (Freedom): শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের স্বাধীনতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? পশ্চিমবঙ্গের পাঠক্রম ও শিক্ষা ব্যবস্থা কি সেই স্বাধীনতাকে উৎসাহিত করে, নাকি সংকুচিত করে?
৪. শৃঙ্খলা (Discipline): শৃঙ্খলার ধারণা এবং তার প্রয়োগ শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের পাঠক্রম কি স্বতঃস্ফূর্ত শৃঙ্খলাকে উৎসাহিত করে, নাকি দমনমূলক শৃঙ্খলার উপর নির্ভরশীল?
এই চারটি দৃষ্টিকোণ থেকে পশ্চিমবঙ্গের স্কুল শিক্ষার দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্তরের পাঠক্রমকে বিশ্লেষণ করলে আমরা তার শক্তি, দুর্বলতা এবং ভবিষ্যতের সংস্কারের পথ সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারব। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে, যেখানে জ্ঞান এবং দক্ষতার সংজ্ঞা দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, সেখানে আমাদের রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা প্রাসঙ্গিক এবং ভবিষ্যৎমুখী, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা অত্যন্ত জরুরি। এই আলোচনাটি কেবল একটি অ্যাকাডেমিক বিশ্লেষণ নয়, এটি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ রূপরেখা তৈরির একটি প্রচেষ্টা।
প্রথম অধ্যায়: পাঠক্রমের নীতি এবং পশ্চিমবঙ্গের পাঠক্রমের মূল্যায়ন (Principles of Curriculum and Evaluation of the W.B. Curriculum)
কোনো পাঠক্রমকে মূল্যায়ন করার আগে, একটি আদর্শ পাঠক্রমের মৌলিক নীতিগুলি সম্পর্কে ধারণা থাকা আবশ্যক। শিক্ষাবিদ এবং মনোবিদরা বিশ্বজুড়ে এমন কিছু নীতির কথা বলেছেন, যা একটি পাঠক্রমকে সফল, কার্যকর এবং শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক করে তোলে।
১.১ পাঠক্রমের প্রধান নীতিসমূহ (Major Principles of Curriculum)
একটি সুসংগঠিত এবং আধুনিক পাঠক্রম নিম্নলিখিত নীতিগুলির উপর ভিত্তি করে গঠিত হওয়া উচিত:
- শিশুকেন্দ্রিকতার নীতি (Principle of Child-centricity): এই নীতি অনুসারে, পাঠক্রমের কেন্দ্রে থাকবে শিশু। তার বয়স, ক্ষমতা, আগ্রহ, চাহিদা এবং মানসিক বিকাশের স্তর অনুযায়ী পাঠক্রম রচিত হবে। জ্যাঁ-জ্যাক রুশো, জন ডিউই, মারিয়া মন্টেসরির মতো শিক্ষাবিদরা এই নীতির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। পাঠক্রম এমন হওয়া উচিত যা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে সহায়তা করে, তার উপর বোঝা হয়ে দাঁড়ায় না।
- সমাজকেন্দ্রিকতার নীতি (Principle of Social-centricity): শিক্ষার্থী কেবল একজন ব্যক্তি নয়, সে সমাজেরও একটি অংশ। তাই পাঠক্রমকে অবশ্যই সামাজিক চাহিদা, সমস্যা এবং আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। শিক্ষা শিক্ষার্থীকে সামাজিকীকরণে সাহায্য করবে এবং তাকে একজন দায়িত্বশীল নাগরিকে পরিণত করবে। পাঠক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানবে।
- নমনীয়তার নীতি (Principle of Flexibility): পাঠক্রম অনমনীয় বা কঠোর হওয়া উচিত নয়। এটি পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি, শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত পার্থক্য এবং স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তিত হওয়ার সুযোগ থাকা উচিত। সব শিক্ষার্থীর জন্য একই মাপের পোশাক যেমন উপযুক্ত নয়, তেমনই সকলের জন্য একই ধরনের অনমনীয় পাঠক্রম কার্যকর হতে পারে না। বিষয় নির্বাচন, শেখার গতি এবং মূল্যায়নের পদ্ধতিতে নমনীয়তা থাকা প্রয়োজন।
- সৃজনশীলতা ও কার্যকারিতার নীতি (Principle of Creativity and Activity): শিক্ষা শুধুমাত্র তথ্য সংগ্রহ নয়, বরং জ্ঞানের সৃষ্টি এবং প্রয়োগ। জন ডিউই-এর বিখ্যাত উক্তি “Learning by doing” বা কাজের মাধ্যমে শেখা—এই নীতির মূল কথা। পাঠক্রম এমন হওয়া উচিত যা শিক্ষার্থীদের নিষ্ক্রিয় শ্রোতা না বানিয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী করে তুলবে। প্রজেক্ট, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, কর্মশালা এবং হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে শেখার সুযোগ থাকতে হবে। এটি শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতাকে উৎসাহিত করবে।
- ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের নীতি (Principle of Conservation of Heritage and Culture): পাঠক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো জাতির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং মূল্যবোধকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেদের শিকড় সম্পর্কে জানতে পারে এবং জাতীয়তাবোধ ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ে গর্বিত হয়।
- ভবিষ্যৎমুখীতার নীতি (Principle of Future-orientation): পাঠক্রমকে কেবল বর্তমানের চাহিদা মেটালেই চলবে না, তাকে ভবিষ্যৎ জীবনের জন্যও শিক্ষার্থীকে প্রস্তুত করতে হবে। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং দক্ষতার উদ্ভব হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর দক্ষতা (21st Century Skills) যেমন—সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা (Critical Thinking), সহযোগিতা (Collaboration), যোগাযোগ (Communication) এবং সৃজনশীলতা (Creativity)—পাঠক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া উচিত।
- সমন্বয়ের নীতি (Principle of Correlation/Integration): পাঠক্রমের বিভিন্ন বিষয়কে বিচ্ছিন্নভাবে না শিখিয়ে তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা উচিত। ইতিহাস ও সাহিত্যের মধ্যে, বা বিজ্ঞান ও গণিতের মধ্যে যৌক্তিক সংযোগ স্থাপন করলে শেখা আরও অর্থপূর্ণ এবং সহজ হয়। জ্ঞানকে সামগ্রিকভাবে দেখতে শেখানোই এই নীতির লক্ষ্য।
- জীবনকেন্দ্রিকতার নীতি (Principle of Life-centricity): শিক্ষা যদি বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত না হয়, তবে তা শিক্ষার্থীর কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ে। পাঠক্রমের বিষয়বস্তু এমন হওয়া উচিত যা শিক্ষার্থীরা তাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা, সমস্যা এবং পরিস্থিতির সঙ্গে মেলাতে পারে। স্বাস্থ্য, পরিবেশ, আর্থিক সাক্ষরতা, মানসিক সুস্থতার মতো জীবন-সম্পর্কিত বিষয়গুলি পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত থাকা প্রয়োজন।
১.২ পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠক্রমের মূল্যায়ন
উপরোক্ত নীতিগুলির আলোকে এবার আমরা পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের পাঠক্রমকে বিশ্লেষণ করব।
- শিশুকেন্দ্রিকতার নিরিখে:
- ইতিবাচক দিক: সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পাঠ্যপুস্তকগুলিকে আরও বেশি শিশুবান্ধব করার চেষ্টা করা হয়েছে। রঙিন ছবি, সহজ ভাষা এবং গল্প বা কথোপকথনের মাধ্যমে বিষয়বস্তু উপস্থাপনের প্রবণতা দেখা যায়, বিশেষ করে নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে। ‘সহজ পাঠ’-এর মতো বইগুলি শিশুর মনস্তত্ত্বকে বোঝার একটি চমৎকার উদাহরণ।
- নেতিবাচক দিক: সামগ্রিকভাবে, পশ্চিমবঙ্গের পাঠক্রম এখনও মূলত বিষয়কেন্দ্রিক (Subject-centric) এবং পরীক্ষাকেন্দ্রিক (Exam-centric)। পাঠক্রমের বিশাল বোঝা (Syllabus overload) শিক্ষার্থীদের উপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। কোন বয়সে কতটা শেখা উচিত, সেই মনস্তাত্ত্বিক বিবেচনার চেয়ে সিলেবাস শেষ করার তাগিদই বেশি দেখা যায়। শিক্ষার্থীর আগ্রহ বা শেখার গতির চেয়ে বোর্ড পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নাবলীর উপর ভিত্তি করে পঠনপাঠন পরিচালিত হয়। ফলে, শেখার আনন্দ হারিয়ে গিয়ে তা একপ্রকার যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান বিভাগে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বা গণিতের যে বিশাল পাঠক্রম রয়েছে, তা অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষেই নির্ধারিত সময়ে আত্মস্থ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
- সমাজকেন্দ্রিকতার নিরিখে:
- ইতিবাচক দিক: ইতিহাস, ভূগোল, জীবনবিজ্ঞান এবং পরিবেশবিদ্যার মতো বিষয়গুলির মাধ্যমে সামাজিক এবং পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করা হয়। ইতিহাস বইতে স্থানীয় ইতিহাস এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার ভূমিকার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, যা প্রশংসনীয়। পরিবেশ দূষণ, সম্পদ সংরক্ষণ, জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয় পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে তাকে সমাজ-সম্পর্কিত করার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়।
- নেতিবাচক দিক: এই বিষয়গুলি মূলত তথ্যভিত্তিক এবং তত্ত্বসর্বস্ব। বাস্তব সামাজিক সমস্যা সমাধানে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। উদাহরণস্বরূপ, পরিবেশবিদ্যা পড়ানো হলেও, স্কুলস্তরে বৃক্ষরোপণ বা দূষণ-বিরোধী কোনো প্রকল্পে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক বা মূল্যায়ন-ভিত্তিক নয়। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে সমাজের জীবন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা বা বিতর্কের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত।
- নমনীয়তার নিরিখে:
- মাধ্যমিক স্তর: মাধ্যমিক স্তরে নমনীয়তার সুযোগ প্রায় শূন্য। সকল শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলকভাবে সাতটি বা আটটি বিষয় পড়তে হয়। এখানে ব্যক্তিগত আগ্রহ বা অনীহার কোনো স্থান নেই।
- উচ্চমাধ্যমিক স্তর: উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান, কলা এবং বাণিজ্য—এই তিনটি গতানুগতিক বিভাগে শিক্ষার্থীদের ভাগ করে দেওয়া হয়। এই বিভাজনটি অত্যন্ত কঠোর। একজন শিক্ষার্থী পদার্থবিদ্যার সঙ্গে ইতিহাস বা দর্শনের মতো বিষয় নিয়ে পড়তে পারে না। এই অনমনীয় কাঠামো শিক্ষার্থীদের বহুধা প্রতিভা বিকাশের পথে একটি বড় অন্তরায়। National Education Policy (NEP) 2020 যেখানে এই ধরনের কঠোর বিভাজন তুলে দেওয়ার কথা বলছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের পাঠক্রম এখনও পুরনো ধারাতেই আবদ্ধ। যদিও কিছু স্কুলে সীমিত কিছু বিকল্প দেওয়া হয়, তবে তা সার্বিক নয়।
- সৃজনশীলতা ও কার্যকারিতার নিরিখে:
- ইতিবাচক দিক: জীবনবিজ্ঞান বা ভূগোলের মতো বিষয়ে কিছু প্রজেক্ট ওয়ার্ক বা প্র্যাকটিক্যালের ব্যবস্থা রয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান বিভাগেปฏิบัติমূলক (Practical) পরীক্ষার উপর নির্দিষ্ট নম্বর বরাদ্দ থাকে।
- নেতিবাচক দিক: এটিই সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের পাঠক্রমের সবচেয়ে দুর্বলতম দিক। শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত মুখস্থ-নির্ভর (Rote-learning based)। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ধরন এমন যে, যে শিক্ষার্থী ভালোভাবে মুখস্থ করতে পারে, সেই ভালো নম্বর পায়। মৌলিক চিন্তা, বিশ্লেষণ বা সৃজনশীলতার প্রয়োগের সুযোগ অত্যন্ত কম। প্রজেক্ট ওয়ার্কগুলিও অনেক ক্ষেত্রে দায়সারাভাবে করা হয়। শিক্ষার্থীরা প্রায়শই বাজার থেকে তৈরি প্রজেক্ট কিনে জমা দেয়, কারণ এর উপর ভিত্তি করে শেখার কোনো তাগিদ বা সঠিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা নেই। হাতে-কলমে শেখার পরিকাঠামো অধিকাংশ স্কুলেই অনুপস্থিত। ফলে, শিক্ষার্থীরা তত্ত্বগতভাবে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ বা শেক্সপীয়রের সনেট সম্পর্কে জানলেও, তাদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা বা সাহিত্যিক সৃজনশীলতা তৈরি হয় না।
- ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের নিরিখে:
- এই ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের পাঠক্রম তুলনামূলকভাবে সফল। বাংলা প্রথম ভাষার পাঠ্যপুস্তকগুলিতে (যেমন ‘সাহিত্য সঞ্চয়ন’ বা ‘সাহিত্য চর্চা’) রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে আধুনিক লেখকদের রচনার समावेश ঘটানো হয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়। ইতিহাস বইতেও বাংলার নবজাগরণ, সমাজ সংস্কার আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালির অবদানের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় গঠনে সাহায্য করে। তবে, এই আলোচনাগুলি অনেক সময় অতিরিক্ত প্রশংসামূলক হয়, সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব দেখা যায়।
- ভবিষ্যৎমুখীতার নিরিখে:
- ইতিবাচক দিক: উচ্চমাধ্যমিক স্তরে কম্পিউটার সায়েন্স এবং কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন বিষয় হিসাবে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিছু বৃত্তিমূলক (Vocational) বিষয়কেও অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
- নেতিবাচক দিক: সামগ্রিকভাবে, পাঠক্রমটি একবিংশ শতাব্দীর দক্ষতার চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ডেটা সায়েন্স, কোডিং, ডিজিটাল লিটারেসির মতো আধুনিক বিষয়গুলির কোনো স্থান নেই। যোগাযোগ দক্ষতা (Communication skills) বা দলগতভাবে কাজ করার (Collaboration) মতো নরম দক্ষতা (Soft skills) বিকাশের কোনো সুসংগঠিত ব্যবস্থা পাঠক্রমের অঙ্গ নয়। ফলে, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর অনেক শিক্ষার্থীই উচ্চশিক্ষা বা চাকরির বাজারের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে ভোগে। পাঠক্রমটি এখনও মূলত শিল্পযুগের মানসিকতা দ্বারা পরিচালিত, তথ্যপ্রযুক্তি যুগের চাহিদা পূরণে এটি অক্ষম।
- সমন্বয়ের নিরিখে:
- পশ্চিমবঙ্গের পাঠক্রমে বিষয়গুলির মধ্যে সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। প্রতিটি বিষয়কে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো করে পড়ানো হয়। ইতিহাসের সঙ্গে সমসাময়িক সাহিত্যের কী সম্পর্ক, বা গণিতের সূত্রগুলি পদার্থবিদ্যায় কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে—এই সংযোগগুলি স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয় না। ফলে, শিক্ষার্থীরা জ্ঞানের একটি সামগ্রিক রূপ দেখতে পায় না এবং তাদের কাছে শেখাটা খণ্ডিত এবং অর্থহীন মনে হতে পারে।
- জীবনকেন্দ্রিকতার নিরিখে:
- পাঠক্রম এবং বাস্তব জীবনের মধ্যে একটি বিশাল ব্যবধান বিদ্যমান। আর্থিক সাক্ষরতা (Financial literacy), মানসিক স্বাস্থ্য (Mental health), লিঙ্গ সংবেদনশীলতা (Gender sensitivity), আইনি অধিকার (Legal rights) বা বিপর্যয় মোকাবিলা (Disaster management)-র মতো অত্যন্ত জরুরি জীবন-সম্পর্কিত বিষয়গুলি হয় অনুপস্থিত, অথবা থাকলেও অত্যন্ত গুরুত্বহীনভাবে আলোচিত। শিক্ষা যদি শিক্ষার্থীকে দৈনন্দিন জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করতে না পারে, তবে সেই শিক্ষার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
দ্বিতীয় অধ্যায়: সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী (Co-curricular Activities)
সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী, যাকে আগে পাঠ্যক্রম-বহির্ভূত বা Extra-curricular activities বলা হত, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় তাকে পাঠক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে গণ্য করা হয়। এর কারণ হলো, শ্রেণিকক্ষের বাইরে এই ধরনের কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর এমন কিছু গুণের বিকাশ ঘটে যা শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যায় সম্ভব নয়।
২.১ সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীর গুরুত্ব
শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীর ভূমিকা অপরিসীম:
- শারীরিক বিকাশ: খেলাধুলা, ব্যায়াম, ড্রিল ইত্যাদি শারীরিক সুস্থতা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
- মানসিক ও বৌদ্ধিক বিকাশ: বিতর্ক, ক্যুইজ, প্রবন্ধ রচনা, বিজ্ঞান ক্লাব ইত্যাদি শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তি, বিশ্লেষণ ক্ষমতা এবং জ্ঞানের পরিধি বাড়ায়।
- সামাজিক ও প্রাক্ষোভিক বিকাশ: দলগত খেলা, নাটক, সমাজসেবামূলক কাজ ইত্যাদির মাধ্যমে সহযোগিতা, সহনশীলতা, নেতৃত্বদানের ক্ষমতা এবং সহানুভূতি போன்ற সামাজিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটে। এটি শিক্ষার্থীদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতেও শেখায়।
- সৃজনশীলতার বিকাশ: অঙ্কন, সঙ্গীত, নৃত্য, অভিনয়, আবৃত্তি ইত্যাদি শিক্ষার্থীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সৃজনশীল প্রতিভাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়।
- সাংস্কৃতিক বিকাশ: বিভিন্ন উৎসব পালন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজস্ব এবং অন্যান্য সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারে।
- নাগরিকতার প্রশিক্ষণ: ছাত্র সংসদ, মক পার্লামেন্ট ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং দায়িত্বশীল নাগরিক হওয়ার প্রশিক্ষণ দেয়।
২.২ পশ্চিমবঙ্গের পাঠক্রমে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীর অবস্থান
পশ্চিমবঙ্গের স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থায় সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীর একটি নির্দিষ্ট স্থান কাগজে-কলমে রয়েছে। যেমন:
- কর্মশিক্ষা (Work Education) ও শারীরশিক্ষা (Physical Education): মাধ্যমিক স্তরে এই দুটি বিষয় বাধ্যতামূলক। এর জন্য নির্দিষ্ট নম্বরও বরাদ্দ থাকে, যা বার্ষিক ফলাফলে যোগ হয়।
- SUPW (Socially Useful Productive Work): এই ধারণাটি কর্মশিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত, যার উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের কিছু সামাজিক বা উৎপাদনমূলক কাজে যুক্ত করা।
- স্কুল স্তরের প্রতিযোগিতা: জেলা এবং রাজ্য স্তরে স্কুল ক্রীড়া, যুব সংসদ প্রতিযোগিতা (Youth Parliament Competition), বিজ্ঞান মেলা ইত্যাদি আয়োজিত হয়।
২.৩ বাস্তবতা এবং কার্যকারিতার মূল্যায়ন
কাগজে-কলমে যা-ই থাকুক না কেন, পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ স্কুলে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীর বাস্তব চিত্রটি অত্যন্ত হতাশাজনক।
- গুরুত্বহীনতা এবং অবহেলা: বোর্ড পরীক্ষার 엄청 চাপের কারণে শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং এমনকি অনেক শিক্ষকও সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীকে সময়ের অপচয় বলে মনে করেন। শারীরশিক্ষা বা কর্মশিক্ষার ক্লাসগুলিকে প্রায়শই অন্যান্য ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বিষয়ের (যেমন গণিত বা ভৌতবিজ্ঞান) ক্লাস নেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়। এই বিষয়গুলির জন্য বরাদ্দ নম্বর প্রায় সকলকেই উদারভাবে দিয়ে দেওয়া হয়, ফলে এর গুরুত্ব সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যায়।
- পরিকাঠামোর অভাব: অধিকাংশ সরকারি এবং সরকার-পোষিত স্কুলে খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত মাঠ নেই। সঙ্গীত, অঙ্কন বা অন্যান্য সৃজনশীল কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বা পৃথক ঘরের অভাব প্রকট। বিশেষ করে গ্রামীণ স্কুলগুলির অবস্থা আরও শোচনীয়। যেখানে পানীয় জল বা শৌচাগারের মতো মৌলিক সুবিধা নেই, সেখানে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীর জন্য পরিকাঠামোর আশা করা বৃথা।
- প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব: শারীরশিক্ষা ছাড়া অন্যান্য সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী, যেমন—নাটক, সঙ্গীত, বিতর্ক বা অঙ্কনের জন্য কোনো প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ করা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে বাংলা বা ইতিহাসের শিক্ষককেই এই দায়িত্বগুলি পালন করতে হয়, যার ফলে এর গুণমান বজায় থাকে না।
- শহর-গ্রামের বৈষম্য: কলকাতার কিছু精英 বেসরকারি স্কুল বা ঐতিহ্যবাহী সরকারি স্কুলগুলিতে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীর একটি চমৎকার পরিবেশ রয়েছে। সেখানে নিয়মিত বিতর্ক, নাটক, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বা বিভিন্ন ক্লাব (যেমন—ডিবেটিং ক্লাব, নেচার ক্লাব) সক্রিয় থাকে। কিন্তু রাজ্যের সিংহভাগ স্কুল, বিশেষ করে গ্রাম বা মফস্বলের স্কুলগুলিতে এই ধরনের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। এই বৈষম্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুযোগের একটি বিশাল পার্থক্য তৈরি করে।
- সিস্টেমিক ব্যর্থতা: মূল সমস্যাটি হলো, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীকে মূল্যায়নের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে গ্রহণ করতে পারেনি। যতদিন না এই কার্যাবলীগুলির উপর ভিত্তি করে গ্রেডেশন বা বোর্ড পরীক্ষার নম্বরের সঙ্গে যুক্ত করার একটি বিশ্বাসযোগ্য এবং স্বচ্ছ ব্যবস্থা তৈরি হবে, ততদিন এগুলি অবহেলিতই থেকে যাবে। একজন ভালো ক্রিকেটার বা বিতর্কपटু শিক্ষার্থীর কোনো অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি নেই, যা তাকে এই ক্ষেত্রগুলিতে আরও উৎসাহিত করতে পারে।
সুতরাং, পশ্চিমবঙ্গের পাঠক্রম সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীর গুরুত্বকে স্বীকার করলেও, তার সফল রূপায়ণে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। এর ফলে, আমরা এমন এক প্রজন্ম তৈরি করছি যারা হয়তো পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাচ্ছে, কিন্তু তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে। তারা দলবদ্ধভাবে কাজ করতে, নেতৃত্ব দিতে বা সৃজনশীলভাবে চিন্তা করতে শিখছে না।
তৃতীয় অধ্যায়: স্বাধীনতা (Freedom)
শিক্ষা ব্যবস্থায় ‘স্বাধীনতা’ একটি বহুমাত্রিক ধারণা। এর অর্থ শুধু অনুপস্থিতি নয়, বরং এটি শিক্ষার্থীর আত্মবিকাশ এবং শিক্ষকের পেশাগত সৃজনশীলতার একটি অপরিহার্য শর্ত।
৩.১ শিক্ষা ক্ষেত্রে স্বাধীনতার বিভিন্ন রূপ
- শিক্ষার্থীর স্বাধীনতা (Freedom of the Learner):
- বিষয় নির্বাচনের স্বাধীনতা: নিজের আগ্রহ ও সামর্থ্য অনুযায়ী বিষয় বেছে নেওয়ার সুযোগ।
- শেখার পদ্ধতির স্বাধীনতা: নিজের গতিতে এবং নিজের পছন্দের পদ্ধতিতে শেখার স্বাধীনতা।
- মত প্রকাশের স্বাধীনতা: নির্ভয়ে প্রশ্ন করার, নিজের মতামত প্রকাশ করার এবং প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করার স্বাধীনতা।
- ভুল করার স্বাধীনতা: শেখার প্রক্রিয়ায় ভুল করা একটি স্বাভাবিক অঙ্গ। ভুলের জন্য তিরস্কৃত না হয়ে, তা থেকে শেখার সুযোগ পাওয়াই হলো প্রকৃত স্বাধীনতা।
- শিক্ষকের স্বাধীনতা (Freedom of the Teacher):
- পদ্ধতিগত স্বাধীনতা (Methodological Freedom): পাঠ্যপুস্তকের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন আকর্ষণীয় এবং উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে পড়ানোর স্বাধীনতা।
- পাঠক্রমের নমনীয় প্রয়োগের স্বাধীনতা: নির্দিষ্ট পাঠক্রমের কাঠামোর মধ্যে থেকেও স্থানীয় চাহিদা বা শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অনুযায়ী বিষয়বস্তুকে কিছুটা পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করার স্বাধীনতা।
- মূল্যায়নের স্বাধীনতা: শুধুমাত্র গতানুগতিক পরীক্ষার মাধ্যমে নয়, বিভিন্ন ধরনের গঠনমূলক মূল্যায়নের (Formative Assessment) মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি বিচার করার স্বাধীনতা।
৩.২ পশ্চিমবঙ্গের পাঠক্রম ও শিক্ষা ব্যবস্থায় স্বাধীনতার মূল্যায়ন
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যদি স্বাধীনতার নিরিখে বিচার করা হয়, তবে একটি সীমাবদ্ধ এবং নিয়ন্ত্রিত ಚಿತ್ರই ফুটে ওঠে।
- শিক্ষার্থীর স্বাধীনতার অভাব:
- বিষয় নির্বাচনে সীমাবদ্ধতা: আগেই আলোচিত হয়েছে যে, উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্যের কঠোর বিভাজন শিক্ষার্থীদের পছন্দের স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে খর্ব করে। একজন শিক্ষার্থী চাইলেই তার পছন্দের বিভিন্ন বিষয়ের সমন্বয় ঘটাতে পারে না।
- পাঠ্যপুস্তক-কেন্দ্রিকতা: পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত পাঠ্যপুস্তক-সর্বস্ব (Textbook-driven)। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কোনো প্রশ্ন করা বা আলোচনা করাকে প্রায়শই অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করা হয়। শিক্ষার্থীদের রেফারেন্স বই পড়া বা ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহের মতো অভ্যাসকে উৎসাহিত করা হয় না।
- প্রশ্ন করার ভীতি: শ্রেণিকক্ষে একটি প্রশ্ন-উত্তর পর্ব থাকলেও, তা মূলত শিক্ষকের ചോദ്യ এবং শিক্ষার্থীর উত্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শিক্ষার্থীরা মৌলিক বা desafiador প্রশ্ন করতে ভয় পায়, কারণ তাতে ‘বোকা’ প্রতিপন্ন হওয়ার বা শিক্ষকের রোষে পড়ার আশঙ্কা থাকে। একটি ভয়-ভিত্তিক পরিবেশে জ্ঞানের উন্মুক্ত আলোচনা সম্ভব নয়।
- পরীক্ষা পদ্ধতির দাসত্ব: সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাটি বোর্ড পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। শিক্ষার্থী কী শিখল, তার চেয়ে পরীক্ষায় কত নম্বর পেল, সেটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই নম্বর পাওয়ার খেলাটি শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক কৌতূহল এবং শেখার আনন্দকে গলা টিপে হত্যা করে। সে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার পরিবর্তে, ‘সাজেশন’ বা সম্ভাব্য প্রশ্নাবলীর পিছনে দৌড়ায়।
- শিক্ষকের স্বাধীনতার অভাব:
- সিলেবাস শেষ করার চাপ: শিক্ষকদের উপর একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিশাল সিলেবাস শেষ করার প্রচণ্ড চাপ থাকে। এই চাপের কারণে তাদের পক্ষে উদ্ভাবনী বা সময়সাপেক্ষ কোনো শিক্ষণ পদ্ধতি অবলম্বন করা সম্ভব হয় না। লেকচার পদ্ধতিই হয়ে ওঠে একমাত্র উপায়।
- প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ: অনেক ক্ষেত্রে স্কুল প্রশাসন বা পরিচালন সমিতির পক্ষ থেকে শিক্ষকদের উপর নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে পড়ানো বা ভালো ‘ফলাফল’ দেখানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। এটি তাদের পেশাগত স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে।
- ঐতিহ্যবাহী মানসিকতা: বহু শিক্ষকও গতানুগতিক পদ্ধতিতে পড়াতে অভ্যস্ত। তাঁরা নিজেরা যে ব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়েছেন, সেই ব্যবস্থার বাইরে বেরোতে চান না। ফলে, স্বাধীনতার সুযোগ থাকলেও তাঁরা তা ব্যবহার করতে পারেন না বা চান না।
- মূল্যায়ন পদ্ধতির কঠোরতা: বোর্ড দ্বারা নির্ধারিত প্রশ্নপত্রের ধরন এবং মূল্যায়ন পদ্ধতির কারণে শিক্ষকরাও বাধ্য হন সেই নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যেই শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করতে। গঠনমূলক বা ধারাবাহিক মূল্যায়নের (Continuous and Comprehensive Evaluation – CCE) ধারণাটি কিছু স্কুলে চালু করার চেষ্টা হলেও, তা সার্বিকভাবে সফল হয়নি।
শিক্ষাব্যবস্থায় স্বাধীনতার এই অভাবের ফল সুদূরপ্রসারী। এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং সৃজনশীলতার বিকাশে বাধা দেয়। তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে বা ঝুঁকি নিতে শেখে না, যা পরবর্তীকালে তাদের পেশাগত এবং ব্যক্তিগত জীবনে সমস্যার সৃষ্টি করে। একটি পরাধীন মন থেকে মহান সৃষ্টি বা উদ্ভাবন আশা করা যায় না।
চতুর্থ অধ্যায়: শৃঙ্খলা (Discipline)
শৃঙ্খলা শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। কিন্তু ‘শৃঙ্খলা’ শব্দটি নিয়ে দুটি ভিন্ন ধারণা প্রচলিত আছে। একটি হলো দমনমূলক বা বাহ্যিক শৃঙ্খলা, এবং অন্যটি হলো স্বতঃস্ফূর্ত বা আত্ম-শৃঙ্খলা।
৪.১ শৃঙ্খলার দুটি ধারণা
- দমনমূলক শৃঙ্খলা (Repressive Discipline): এই ধারণাটি ভয়, শাস্তি এবং কঠোর নিয়মের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এখানে শিক্ষার্থীদের উপর বাইরে থেকে শৃঙ্খলা চাপিয়ে দেওয়া হয়। শিক্ষকের বা কর্তৃপক্ষের প্রতি অন্ধ আনুগত্যই এখানে শৃঙ্খলার পরিমাপক। এই ধরনের শৃঙ্খলায় শিক্ষার্থীরা নিয়ম মেনে চলে শাস্তির ভয়ে, বিবেকের তাড়নায় নয়। এটি একটি স্বৈরাচারী পরিবেশ তৈরি করে এবং শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশকে বাধা দেয়।
- আত্ম-শৃঙ্খলা বা স্বতঃস্ফূর্ত শৃঙ্খলা (Self-discipline/Spontaneous Discipline): আধুনিক শিক্ষাবিদরা এই ধরনের শৃঙ্খলার উপর জোর দেন। এখানে শৃঙ্খলা আসে ভিতর থেকে, শিক্ষার্থীর নিজস্ব বোধ, দায়িত্ব এবং মূল্যবোধ থেকে। শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে কেন নিয়ম মেনে চলা প্রয়োজন এবং তারা স্বেচ্ছায় তা পালন করে। এই ধরনের শৃঙ্খলা একটি গণতান্ত্রিক এবং সহযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করে। এর লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীকে আত্ম-নিয়ন্ত্রণে সক্ষম করে তোলা, যাতে শিক্ষকের অনুপস্থিতিতেও সে সঠিক আচরণ করে। জন ডিউই একে ‘সামাজিক শৃঙ্খলা’ বলেছেন, যা সামাজিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্জিত হয়।
৪.২ পশ্চিমবঙ্গের পাঠক্রম ও শিক্ষা ব্যবস্থায় শৃঙ্খলার মূল্যায়ন
পশ্চিমবঙ্গের স্কুলগুলিতে শৃঙ্খলার ধারণাটি মূলত প্রথম প্রকারের, অর্থাৎ দমনমূলক বা বাহ্যিক শৃঙ্খলার উপর নির্ভরশীল।
- ভয়-ভিত্তিক পরিবেশ: অনেক স্কুলেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের সম্পর্ক ভয় এবং দূরত্বের। শারীরিক শাস্তি আইনত নিষিদ্ধ হলেও, মানসিক শাস্তি বা বকাবকির ব্যবহার এখনও প্রচলিত। ‘পিন ড্রপ সাইলেন্স’ বা নিস্তব্ধ শ্রেণিকক্ষকে একটি আদর্শ পরিস্থিতি বলে মনে করা হয়, যা আসলে একটি দমনমূলক পরিবেশের লক্ষণ।
- নিয়মের কঠোরতা: নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম, চুল বাঁধার নিয়ম, স্কুলে ঢোকা বা বেরোনোর সময় ইত্যাদি কঠোরভাবে আরোপ করা হয়। এই নিয়মগুলির উপযোগিতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয় না। নিয়ম ভাঙলে শাস্তির বিধান থাকে। এই বাহ্যিক নিয়মাবলী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্ম-শৃঙ্খলা তৈরিতে সাহায্য করে না।
- পাঠক্রমের ভূমিকা: পাঠক্রমের গঠনই এক ধরনের বাহ্যিক শৃঙ্খলা তৈরি করে। বিশাল সিলেবাস, রুটিন-বাঁধা ক্লাস, পরীক্ষার চাপ—এই সবকিছুই শিক্ষার্থীদের একটি নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর মধ্যে বেঁধে রাখে। তাদের স্বাধীনভাবে কিছু করার বা চিন্তা করার অবকাশ থাকে না। এই কাঠামো তাদের নিষ্ক্রিয় এবং অনুগত করে তোলে।
- আত্ম-শৃঙ্খলার সুযোগের অভাব: আত্ম-শৃঙ্খলা গড়ে ওঠে দায়িত্বগ্রহণের মাধ্যমে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব দেওয়ার সুযোগ অত্যন্ত কম। ছাত্র সংসদ বা স্টুডেন্ট কাউন্সিল থাকলেও, অনেক স্কুলেই তা নামমাত্র। স্কুলের নিয়মকানুন তৈরি বা কোনো অনুষ্ঠান আয়োজনে শিক্ষার্থীদের মতামত বা অংশগ্রহণের সুযোগ প্রায় নেই। সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীর অভাবের কারণেও তারা দলবদ্ধভাবে দায়িত্ব নিতে শেখে না।
- ইতিবাচক পরিবর্তন: অবশ্যই, সব স্কুল বা সব শিক্ষক একরকম নন। অনেক শিক্ষকই এখন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত শৃঙ্খলায় উৎসাহিত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এটি ব্যক্তিগত উদ্যোগের উপর নির্ভরশীল, সামগ্রিক ব্যবস্থার প্রতিফলন নয়।
সুতরাং, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চায়। এটি হয়তো तात्ক্ষণিকভাবে স্কুলের পরিবেশ শান্ত রাখে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসী, দায়িত্বশীল এবং স্ব-নিয়ন্ত্রিত নাগরিকে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়। প্রকৃত শৃঙ্খলা আসে স্বাধীনতা এবং দায়িত্ববোধের মেলবন্ধন থেকে, যা আমাদের ব্যবস্থায় অনুপস্থিত।
পঞ্চম অধ্যায়: সমস্যা, সমালোচনা এবং সুপারিশ (Problems, Criticisms, and Recommendations)
পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলির আলোচনার ভিত্তিতে আমরা পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠক্রম এবং শিক্ষা ব্যবস্থার কিছু মৌলিক সমস্যা চিহ্নিত করতে পারি এবং তার নিরিখে কিছু সংস্কারের প্রস্তাব দিতে পারি।
৫.১ প্রধান সমস্যা ও সমালোচনা (Major Problems and Criticisms)
- পরীক্ষাকেন্দ্রিকতা ও মুখস্থ-নির্ভরতা: সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাটি বোর্ড পরীক্ষার ফলাফলের উপর অত্যধিক নির্ভরশীল। এর ফলে মুখস্থ বিদ্যাকে উৎসাহিত করা হয় এবং শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণাত্মক ও সৃজনশীল ক্ষমতা উপেক্ষিত হয়।
- বাস্তব-বিচ্ছিন্ন এবং তাত্ত্বিক পাঠক্রম: পাঠক্রমের বিষয়বস্তু বহুলাংশে বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন এবং তাত্ত্বিক। এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয় এবং অর্জিত জ্ঞান বাস্তব জীবনে প্রয়োগের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
- অনমনীয় কাঠামো: বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে নমনীয়তার অভাব এবং বিজ্ঞান-কলা-বাণিজ্যের কঠোর বিভাজন শিক্ষার্থীদের বহুধা প্রতিভা বিকাশের পথে অন্তরায়।
- সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীর চরম অবহেলা: শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্য অপরিহার্য হওয়া সত্ত্বেও, সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী বাস্তবে গুরুত্বহীন এবং অবহেলিত।
- স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার অভাব: শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক উভয়েরই স্বাধীনতার অভাব রয়েছে। এর ফলে একটি ভীতি-ভিত্তিক, অনুগত এবং সৃজনশীলতাহীন পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
- ত্রুটিপূর্ণ মূল্যায়ন ব্যবস্থা: মূল্যায়ন ব্যবস্থা শুধুমাত্র স্মৃতিনির্ভর জ্ঞানকে পরিমাপ করে। ধারাবাহিক এবং সামগ্রিক মূল্যায়নের (CCE) কার্যকরী প্রয়োগ নেই। প্রজেক্ট বা প্র্যাকটিক্যালের মূল্যায়নও স্বচ্ছ নয়।
- পরিকাঠামোগত ঘাটতি এবং শহর-গ্রাম বৈষম্য: রাজ্যের অধিকাংশ স্কুলে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি বা খেলার মাঠ নেই। শহর এবং গ্রামের স্কুলগুলির মধ্যে সুযোগ-সুবিধার আকাশ-পাতাল পার্থক্য বিদ্যমান।
- শিক্ষক প্রশিক্ষণের অভাব: শিক্ষকদের আধুনিক শিক্ষণ পদ্ধতি, শিশু মনস্তত্ত্ব এবং নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষণের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ফলে, তাঁরা পুরনো পদ্ধতিতেই পাঠদান চালিয়ে যান।
৫.২ সুপারিশ এবং ভবিষ্যৎ展望 (Recommendations and Future Outlook)
এই সমস্যাগুলি থেকে উত্তরণের জন্য একটি সামগ্রিক এবং সাহসী সংস্কার প্রয়োজন। National Curriculum Framework (NCF) 2005 এবং National Education Policy (NEP) 2020-এর নির্দেশিকা এক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হতে পারে।
- পাঠক্রমের সংস্কার (Curriculum Reform):
- বিষয়বস্তু হ্রাস: পাঠক্রম থেকে অপ্রয়োজনীয় এবং অতিরিক্ত তথ্যভার কমাতে হবে। মূল ধারণা (Core Concepts) এবং দক্ষতার উপর জোর দিতে হবে।
- নমনীয়তা আনয়ন: উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নমনীয়তা আনতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন শাখার বিষয় নিয়ে পড়তে পারে।
- একবিংশ শতাব্দীর দক্ষতার অন্তর্ভুক্তি: পাঠক্রমে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, সমস্যা সমাধান, ডিজিটাল লিটারেসি, কোডিং এবং যোগাযোগ দক্ষতার মতো বিষয়গুলিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
- জীবনমুখী শিক্ষা: আর্থিক সাক্ষরতা, মানসিক স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা এবং পরিবেশ সচেতনতার মতো বিষয়গুলিকে আবশ্যিক করতে হবে।
- মূল্যায়ন ব্যবস্থার সংস্কার (Evaluation System Reform):
- বোর্ড পরীক্ষার গুরুত্ব কমাতে হবে এবং ধারাবাহিক ও সামগ্রিক মূল্যায়নের (CCE) উপর জোর দিতে হবে। সারা বছর ধরে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা, প্রজেক্ট, গ্রুপ ওয়ার্ক, এবং ক্লাসের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে।
- প্রশ্নপত্রের ধরন বদলাতে হবে। মুখস্থ-নির্ভর প্রশ্নের পরিবর্তে বোধমূলক (Understanding), প্রয়োগমূলক (Application) এবং বিশ্লেষণাত্মক (Analysis) প্রশ্ন করতে হবে।
- সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীকে গুরুত্বদান:
- খেলাধুলা, সঙ্গীত, শিল্পকলা এবং অন্যান্য সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীকে মূল পাঠক্রমের সমতুল্য গুরুত্ব দিতে হবে।
- এই কার্যাবলীগুলির জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে।
- এগুলির উপর ভিত্তি করে গ্রেড দিতে হবে যা চূড়ান্ত ফলাফলে প্রভাব ফেলবে।
- স্বাধীনতা ও শৃঙ্খলার নতুন ধারণা প্রতিষ্ঠা:
- শ্রেণিকক্ষে একটি ভয়মুক্ত এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেখানে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে প্রশ্ন করতে পারে।
- শিক্ষকদের পাঠদানের পদ্ধতিতে আরও স্বাধীনতা দিতে হবে।
- দমনমূলক শৃঙ্খলার পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব দিয়ে তাদের মধ্যে আত্ম-শৃঙ্খলা গড়ে তোলার উপর জোর দিতে হবে।
- শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও ক্ষমতায়ন (Teacher Training and Empowerment):
- শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত এবং উন্নত মানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের নতুন শিক্ষণ কৌশল এবং প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত করাতে হবে।
- শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদাবোধ বাড়াতে হবে এবং তাদের ক্ষমতায়ন করতে হবে।
- প্রযুক্তি এবং পরিকাঠামোর উন্নয়ন:
- সমস্ত স্কুলে স্মার্ট ক্লাসরুম, কম্পিউটার ল্যাব এবং দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবস্থা করতে হবে।
- বিশেষ করে গ্রামীণ স্কুলগুলির পরিকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ নজর দিতে হবে যাতে শহর-গ্রামের বৈষম্য কমে।
পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠক্রমের এই বিস্তৃত মূল্যায়ন থেকে হয় যে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা একটি কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে এর একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য এবং শক্তিশালী তাত্ত্বিক ভিত্তি রয়েছে, বিশেষ করে সাহিত্য ও ইতিহাসের মতো বিষয়গুলিতে। অন্যদিকে, আধুনিক শিক্ষাদর্শনের নীতিগুলির নিরিখে এটি বহুলাংশে পিছিয়ে পড়েছে। পাঠক্রমটি এখনও মূলত পরীক্ষাকেন্দ্রিক, অনমনীয়, মুখস্থ-নির্ভর এবং বাস্তব-বিচ্ছিন্ন। এটি শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা ও স্বাধীনতার বিকাশকে উৎসাহিত করার পরিবর্তে সংকুচিত করে। সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী অবহেলিত এবং শৃঙ্খলার ধারণাটি মূলত দমনমূলক।
এই পরিস্থিতি রাতারাতি বদলানো সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন একটি দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আমূল নীতি পরিবর্তন এবং একটি সামাজিক আন্দোলন। অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং নীতিনির্ধারক—সকলকেই তাদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে, শিক্ষার লক্ষ্য শুধু ভালো নম্বর পাওয়া বা একটি চাকরি জোগাড় করা নয়, এর আসল উদ্দেশ্য হলো একজন সম্পূর্ণ মানুষ তৈরি করা—যে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে, সৃজনশীল হতে পারে, দায়িত্বশীল হতে পারে এবং পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।
যদি আমরা একবিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমবঙ্গকে আবার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসাবে দেখতে চাই, তবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার এই মৌলিক সংস্কারের পথে হাঁটা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। পাঠক্রমকে মুক্ত করতে হবে, শিক্ষাকে আনন্দদায়ক করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের ডানা মেলে দেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। তবেই আমরা এমন এক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করতে পারব, যারা শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, সমগ্র ভারতের মুখ উজ্জ্বল করবে।