পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ

(West Bengal Council of Higher Secondary Education)

 

১. সাধারণ পরিচিতি (General Introduction)

পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ (West Bengal Council of Higher Secondary Education বা WBCHSE) হলো পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি স্বশাসিত এবং বিধিবদ্ধ সংস্থা, যা রাজ্যের উচ্চমাধ্যমিক স্তরের (একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি) শিক্ষার তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নয়নের জন্য দায়বদ্ধ। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় গৃহীত “পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ আইন, ১৯৭৫” (West Bengal Council of Higher Secondary Education Act, 1975) অনুসারে এই সংসদটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ১৯৭৬ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাজকর্ম শুরু করে। সংসদের প্রধান কার্যালয় কলকাতার সল্টলেকে অবস্থিত, যার নাম ‘বিদ্যাসাগর ভবন’।

এই সংসদের মূল উদ্দেশ্য হলো পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের (WBBSE) মাধ্যমিক পরীক্ষার পরবর্তী দুই বছরের (+2 স্তর) শিক্ষার একটি সুসংহত এবং মানসম্মত কাঠামো প্রদান করা। এই স্তরটি ছাত্রছাত্রীদের জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, কারণ এটি স্কুল শিক্ষা এবং উচ্চতর শিক্ষার (বিশ্ববিদ্যালয় বা পেশাগত কোর্স) মধ্যে একটি সেতু হিসেবে কাজ করে। সংসদের প্রধান কাজগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিকে অনুমোদন প্রদান করা।

  • একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির জন্য পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি নির্ধারণ করা।

  • দ্বাদশ শ্রেণির শেষে বার্ষিক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা (Higher Secondary Examination) পরিচালনা করা।

  • পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা এবং ছাত্রছাত্রীদের শংসাপত্র (Certificate) প্রদান করা।

  • শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নের জন্য গবেষণা ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করা।

সংসদটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ গঠনে এক निर्णायक ভূমিকা পালন করে আসছে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলই রাজ্যের ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, সাধারণ ডিগ্রি কোর্স এবং অন্যান্য পেশাগত কোর্সে ভর্তির ভিত্তি তৈরি করে। তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম।

২. পাঠ্যক্রম (Curriculum)

পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের পাঠ্যক্রমটি অত্যন্ত আধুনিক এবং ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ শিক্ষার চাহিদার কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে। এটি ছাত্রছাত্রীদের পছন্দের বিষয় বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট স্বাধীনতা প্রদান করে, যাতে তারা তাদের আগ্রহ এবং যোগ্যতা অনুযায়ী নিজেদের পথ বেছে নিতে পারে। পাঠ্যক্রমটি মূলত দুটি অংশে বিভক্ত: একাদশ শ্রেণি এবং দ্বাদশ শ্রেণি। উভয় শ্রেণির পাঠ্যক্রমের উপর ভিত্তি করে দ্বাদশ শ্রেণির শেষে চূড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

বিষয় কাঠামো:
উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ছাত্রছাত্রীদের দুটি আবশ্যিক বিষয় এবং তিনটি ঐচ্ছিক বিষয় (Elective Subjects) নিতে হয়। তারা চাইলে একটি অতিরিক্ত ঐচ্ছিক বিষয়ও (Optional Elective) নিতে পারে।

ক) আবশ্যিক বিষয় (Compulsory Subjects):
এই দুটি বিষয় সকল বিভাগের (বিজ্ঞান, বাণিজ্য, কলা) ছাত্রছাত্রীদের জন্য বাধ্যতামূলক।

  1. প্রথম ভাষা (First Language): ছাত্রছাত্রীরা বাংলা, হিন্দি, নেপালি, উর্দু, সাঁওতালি, ওড়িয়া, তেলেগু, গুজরাটি, পাঞ্জাবি ইত্যাদি ভাষার মধ্যে যেকোনো একটি বেছে নিতে পারে। বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীর জন্য এটি বাংলা।

  2. দ্বিতীয় ভাষা (Second Language): প্রায় সকল ছাত্রছাত্রীর জন্য দ্বিতীয় ভাষা হলো ইংরেজি। তবে যাদের প্রথম ভাষা ইংরেজি, তারা বিকল্প হিসেবে বাংলা বা হিন্দি নিতে পারে।

খ) ঐচ্ছিক বিষয় (Elective Subjects):
ছাত্রছাত্রীদের তিনটি ঐচ্ছিক বিষয় বেছে নিতে হয়, যা মূলত তাদের বিভাগ (Stream) নির্ধারণ করে। সংসদ মোট তিনটি প্রধান বিভাগ বা স্ট্রিম অফার করে:

  1. বিজ্ঞান বিভাগ (Science Stream): এই বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের প্রধানত নিম্নলিখিত বিষয়গুলি থেকে বেছে নিতে হয়:

    • পদার্থবিদ্যা (Physics)

    • রসায়নবিদ্যা (Chemistry)

    • গণিত (Mathematics)

    • জীববিজ্ঞান (Biological Sciences)

    • কম্পিউটার সায়েন্স (Computer Science)

    • পরিসংখ্যান (Statistics)

    • পুষ্টিবিজ্ঞান (Nutrition)

    • ভূগোল (Geography)

  2. বাণিজ্য বিভাগ (Commerce Stream): এই বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রধান বিষয়গুলি হলো:

    • হিসাবশাস্ত্র (Accountancy)

    • কারবারী শিক্ষা (Business Studies)

    • অর্থনীতি (Economics)

    • কস্টিং ও ট্যাক্সেশন (Costing and Taxation)

    • বাণিজ্যিক আইন ও নিরীক্ষা (Commercial Law and Preliminaries of Auditing)

    • কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন (Computer Application)

    • গণিত (Mathematics)

  3. কলা বিভাগ/মানবিকী (Arts/Humanities Stream): এই বিভাগে বিষয়ের বৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশি। কিছু জনপ্রিয় বিষয় হলো:

    • ইতিহাস (History)

    • ভূগোল (Geography)

    • রাষ্ট্রবিজ্ঞান (Political Science)

    • দর্শন (Philosophy)

    • সমাজতত্ত্ব (Sociology)

    • শিক্ষাবিজ্ঞান (Education)

    • মনোবিজ্ঞান (Psychology)

    • অর্থনীতি (Economics)

    • সংগীত (Music)

    • শারীরশিক্ষা (Health & Physical Education)

    • চারুকলা (Fine Arts & Crafts)

মূল্যায়ন পদ্ধতি:
সংসদের মূল্যায়ন পদ্ধতি লিখিত পরীক্ষা (Theory) এবং প্রজেক্ট/প্র্যাকটিক্যালের (Project/Practical) সমন্বয়ে গঠিত।

  • যেসব বিষয়ে প্র্যাকটিক্যাল বা প্রজেক্ট রয়েছে (যেমন— পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ভূগোল, পুষ্টিবিজ্ঞান, কম্পিউটার সায়েন্স ইত্যাদি), সেখানে লিখিত পরীক্ষার জন্য ৮০ নম্বর এবং প্র্যাকটিক্যাল/প্রজেক্টের জন্য ২০ নম্বর বরাদ্দ থাকে।

  • যেসব বিষয়ে প্র্যাকটিক্যাল বা প্রজেক্ট নেই (যেমন— বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, গণিত ইত্যাদি), সেখানে লিখিত পরীক্ষার জন্য ১০০ নম্বর থাকে। তবে বর্তমানে অনেক বিষয়েই ২০ নম্বরের প্রজেক্ট চালু করা হয়েছে।

এই পদ্ধতি ছাত্রছাত্রীদের শুধুমাত্র মুখস্থবিদ্যার উপর নির্ভর না করে হাতে-কলমে কাজ করার এবং বিষয় সম্পর্কে গভীর ধারণা তৈরি করতে উৎসাহিত করে।

৩. পরিচালনা পর্ষদ (Governing Body)

পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ একটি স্বশাসিত সংস্থা হওয়ায় এর একটি সুনির্দিষ্ট পরিচালনা পর্ষদ রয়েছে, যা সংসদের সমস্ত নীতিগত এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই পর্ষদ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিদ্যালয় শিক্ষা দপ্তরের (Department of School Education) অধীনে কাজ করে।

পরিচালনা পর্ষদের গঠনটি বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তৈরি, যা একটি গণতান্ত্রিক ও ভারসাম্যপূর্ণ কাঠামো নিশ্চিত করে। এর গঠন সাধারণত নিম্নরূপ:

  1. সভাপতি (President): সংসদের প্রধান হলেন সভাপতি, যিনি রাজ্য সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হন। তিনি সংসদের সমস্ত সভার সভাপতিত্ব করেন এবং সামগ্রিক কাজকর্মের দিকনির্দেশনা দেন।

  2. সচিব (Secretary): সচিব সংসদের প্রধান কার্যনির্বাহী আধিকারিক। তিনি সংসদের দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজকর্ম, পরীক্ষা পরিচালনা, ফলাফল প্রকাশ এবং অন্যান্য দাপ্তরিক বিষয়গুলি তত্ত্বাবধান করেন।

  3. পর্ষদের সদস্য (Members of the Council): সভাপতি ও সচিব ছাড়াও পর্ষদে আরও অনেক পদাধিকারী ও সদস্য থাকেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন:

    • পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি (President of WBBSE)।

    • রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা তাঁদের প্রতিনিধিরা।

    • রাজ্য সরকারের বিদ্যালয় শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষা দপ্তরের প্রতিনিধিরা।

    • সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলির প্রধান শিক্ষক/শিক্ষিকাদের প্রতিনিধি।

    • শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধি।

    • রাজ্য বিধানসভার নির্বাচিত সদস্য (MLA)।

    • সরকার মনোনীত বিশিষ্ট শিক্ষাবিদগণ।

পরিচালনা পর্ষদের প্রধান কাজ:

  • উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার জন্য নীতি নির্ধারণ ও রূপরেখা তৈরি করা।

  • বিদ্যালয়গুলিকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের জন্য অনুমোদন (Affiliation) দেওয়া বা শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে অনুমোদন প্রত্যাহার করা।

  • পাঠ্যক্রম এবং পাঠ্যসূচি তৈরি, পর্যালোচনা ও আধুনিকীকরণ করা।

  • উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে আয়োজন করা।

  • পাঠ্যপুস্তক নির্বাচন ও প্রকাশনার বিষয়ে নির্দেশিকা দেওয়া।

  • শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষক-প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করা।

  • সংসদের বার্ষিক বাজেট এবং আর্থিক বিষয়গুলি পরিচালনা ও অনুমোদন করা।

এই শক্তিশালী পরিচালনা পর্ষদ নিশ্চিত করে যে সংসদটি রাজ্যের ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি সময়োপযোগী এবং মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা বজায় রাখতে সক্ষম।

৪. বিষয় ও বিদ্যালয়ের সংখ্যা (Number of Subjects and Schools)

বিদ্যালয়ের সংখ্যা:
পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের অধীনে অনুমোদিত বিদ্যালয়ের সংখ্যা অত্যন্ত ব্যাপক। রাজ্য জুড়ে ৭,০০০-এরও বেশি বিদ্যালয় এই সংসদের অধীনে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পাঠদান করে। এই বিদ্যালয়গুলির মধ্যে রয়েছে:

  • সরকারি বিদ্যালয় (Government Schools)

  • সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয় (Government-sponsored/aided Schools)

  • বেসরকারি বিদ্যালয় (Private/Unaided Schools)

  • মাদ্রাসা (Madrasahs)

এই বিশাল সংখ্যক বিদ্যালয়ের মাধ্যমে সংসদ পশ্চিমবঙ্গের শহর, আধা-শহর এবং গ্রামীণ এলাকার লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর কাছে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ পৌঁছে দেয়। প্রতি বছর প্রায় ৭ থেকে ৮ লক্ষ পরীক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে, যা সংসদের কর্মযজ্ঞের বিশালতা প্রমাণ করে।

বিষয়ের সংখ্যা:
সংসদ ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিভিন্ন বিষয়ের একটি বিস্তৃত তালিকা প্রদান করে, যা তাদের ভবিষ্যৎ পথ বেছে নিতে সাহায্য করে।

  • আবশ্যিক বিষয়: ২টি (প্রথম ভাষা ও দ্বিতীয় ভাষা)।

  • ঐচ্ছিক বিষয়: বিজ্ঞান, বাণিজ্য এবং কলা বিভাগ মিলিয়ে ৫০টিরও বেশি ঐচ্ছিক বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে যেমন ঐতিহ্যবাহী বিষয়গুলি (যেমন— ইতিহাস, পদার্থবিদ্যা) রয়েছে, তেমনই আধুনিক এবং পেশাভিত্তিক বিষয়গুলিও (যেমন— পুষ্টিবিজ্ঞান, কম্পিউটার সায়েন্স, কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন, পরিবেশবিদ্যা) অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও ভোকেশনাল স্ট্রিমের অধীনে বিভিন্ন কারিগরি বিষয় পড়ার সুযোগ রয়েছে।

এই বিপুল সংখ্যক বিষয় ছাত্রছাত্রীদের তাদের আগ্রহ, দক্ষতা এবং ভবিষ্যতের লক্ষ্য অনুযায়ী নিজেদের শিক্ষার পথ ডিজাইন করার সুযোগ দেয়।

পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার এক অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। এটি শুধু একটি পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থা নয়, বরং ছাত্রছাত্রীদের স্কুল জীবন থেকে উচ্চশিক্ষার জগতে উত্তরণের পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পথপ্রদর্শক। একটি আধুনিক, বৈচিত্র্যময় এবং ছাত্রকেন্দ্রিক পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে এটি পশ্চিমবঙ্গের তরুণ প্রজন্মকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত করতে নিরন্তর কাজ করে চলেছে।

Similar Posts