ব্যক্তিত্ব এমন একটি ধারণা যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী এবং সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। এটি দৈনন্দিন ভাষায় বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ, তবে বৈজ্ঞানিকভাবে এর অর্থ অত্যন্ত জটিল ও সূক্ষ্ম। মূলত, ব্যক্তিত্ব বলতে বোঝায় চিন্তা, অনুভূতি ও আচরণের সেই স্বতন্ত্র ও তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ধরণসমূহ, যা একজন ব্যক্তিকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। এটি আমাদের পরিবেশের সঙ্গে কিভাবে আমরা মিথস্ক্রিয়া করি, নিজেদেরকে কিভাবে দেখি এবং অন্যরা আমাদেরকে কিভাবে দেখে—এসবের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। এই নোটে ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য, তত্ত্ব, গঠনকারী উপাদান, মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং দৈনন্দিন জীবনে এর গুরুত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী ব্যক্তিত্বকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন:

  • গর্ডন অলপোর্ট (১৯৩৭): “ব্যক্তিত্ব হলো ব্যক্তির মধ্যে অবস্থিত সেই গতিশীল সংগঠন, যা তার মনস্তাত্ত্বিক ও শারীরিক ব্যবস্থা দ্বারা নির্ধারিত হয় এবং যার ফলে সে তার পরিবেশের সঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে মানিয়ে নিতে পারে।”
  • সিগমুন্ড ফ্রয়েড: ব্যক্তিত্বের কেন্দ্রে অবচেতন প্রেরণা ও দ্বন্দ্বকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
  • রেমন্ড ক্যাটেল: “ব্যক্তিত্ব হলো সেই বৈশিষ্ট্য, যা থেকে অনুমান করা যায়, কোনো ব্যক্তি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কী করবে।”

সব সংজ্ঞার মধ্যেই একটি সাধারণ বিষয় হলো, ব্যক্তিত্ব হলো কিছু স্থায়ী বৈশিষ্ট্য ও ধরণসমূহের সমষ্টি, যা একজন ব্যক্তিকে অনন্য করে তোলে।

ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য

১. স্বতন্ত্রতা: প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব স্বতন্ত্র। এমনকি যমজদেরও ব্যক্তিত্ব এক নয়।

২. স্থিতিশীলতা: ব্যক্তিত্ব সাধারণত সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী স্থিতিশীল থাকে, যদিও বড় কোনো জীবন-অভিজ্ঞতার কারণে পরিবর্তিত হতে পারে।

৩. সমন্বয়: ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া যেমন—প্রেরণা, আবেগ, জ্ঞান ও আচরণকে একত্রিত করে।

৪. গতিশীলতা: ব্যক্তিত্ব স্থিতিশীল হলেও এটি অপরিবর্তনীয় নয়। অভিজ্ঞতা, শেখা ও পরিপক্বতার মাধ্যমে এটি বিকশিত হয়।

৫. পরিবর্তনশীলতা: ব্যক্তিত্ব ব্যক্তিকে তার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে।

বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী ব্যক্তিত্বের গঠন ও বিকাশ ব্যাখ্যা করতে বিভিন্ন তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। প্রধান তত্ত্বগুলো হলো—

১. মনোবিশ্লেষণ তত্ত্ব (সিগমুন্ড ফ্রয়েড)

ফ্রয়েডের মতে, ব্যক্তিত্ব গঠনে অবচেতন মন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তিনি ব্যক্তিত্বকে তিনটি উপাদানে ভাগ করেছেন:

  • ইড (Id): মনের আদিম ও প্রবৃত্তিমূলক অংশ, যা যৌন ও আগ্রাসী প্রবৃত্তি ধারণ করে।
  • ইগো (Ego): বাস্তবতাবাদী অংশ, যা ইড ও সুপার-ইগোর মধ্যে সমন্বয় করে।
  • সুপার-ইগো (Super-ego): নৈতিক বিবেক।

ফ্রয়েড মনে করতেন, শৈশবের অভিজ্ঞতা ব্যক্তিত্ব গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বৈশিষ্ট্য তত্ত্বে ব্যক্তিত্বের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত ও পরিমাপের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো “বিগ ফাইভ” মডেল:

  • ওপেননেস টু এক্সপেরিয়েন্স (Openness): সৃজনশীলতা ও নতুন কিছু শেখার আগ্রহ।
  • কনশিয়েনশিয়াসনেস (Conscientiousness): সংগঠিত, দায়িত্বশীল ও শৃঙ্খলাবদ্ধ।
  • এক্সট্রাভার্শন (Extraversion): মিশুক ও আত্মবিশ্বাসী।
  • এগ্রিয়াবলনেস (Agreeableness): সহানুভূতিশীল ও সহযোগিতাপূর্ণ।
  • নিউরোটিসিজম (Neuroticism): আবেগগত অস্থিরতা ও উদ্বেগপ্রবণতা।

এই তত্ত্ব অনুযায়ী, এই বৈশিষ্ট্যগুলো সাধারণত স্থিতিশীল এবং আচরণ পূর্বাভাসে সহায়ক।

মানবিক তত্ত্বে ব্যক্তিগত বিকাশ, আত্ম-উন্নয়ন ও স্বাধীন ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কার্ল রজার্স মনে করেন, ব্যক্তিত্ব বিকাশের মূল চালিকাশক্তি হলো আত্ম-পরিপূর্ণতার আকাঙ্ক্ষা। ম্যাসলো’র চাহিদার স্তরবিন্যাস তত্ত্বও ব্যক্তিত্ব বিকাশে পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জনের গুরুত্ব দেখিয়েছে।

বান্দুরা ব্যক্তিত্ব গঠনে পর্যবেক্ষণমূলক শেখা, আত্ম-দক্ষতা ও সামাজিক প্রভাবের গুরুত্ব দিয়েছেন। তার মতে, ব্যক্তিত্ব গঠনে ব্যক্তিগত উপাদান, আচরণ ও পরিবেশের পারস্পরিক সম্পর্ক (reciprocal determinism) গুরুত্বপূর্ণ।

প্রাচীন তত্ত্ব যেমন—হিপোক্রেটিসের চার স্বভাব ও কার্ল ইয়ুং-এর অন্তর্মুখী- বহির্মুখী শ্রেণিবিভাগ ব্যক্তিত্বকে নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণিতে ভাগ করেছে। যদিও এগুলো এখন কম ব্যবহৃত, তবে পরবর্তীকালে বৈশিষ্ট্য তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেছে।

ব্যক্তিত্ব গঠনে নানা ধরনের উপাদান ভূমিকা রাখে:

১. জৈবিক উপাদান

  • জেনেটিক্স: যমজ ও পরিবারভিত্তিক গবেষণায় দেখা যায়, ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্যের একটি বড় অংশ বংশগত।
  • শারীরিক গঠন ও রাসায়নিক উপাদান: কিছু তত্ত্ব অনুযায়ী, দেহের গঠন ও হরমোনের ভারসাম্য ব্যক্তিত্বে প্রভাব ফেলে।

২. মনস্তাত্ত্বিক উপাদান

  • জ্ঞানীয় প্রক্রিয়া: আমরা কীভাবে চিন্তা করি, উপলব্ধি করি ও স্মরণ করি, তা ব্যক্তিত্বে প্রভাব ফেলে।
  • আবেগ: আবেগ অনুভব ও প্রকাশের ধরণ ব্যক্তিত্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

৩. সামাজিক ও পরিবেশগত উপাদান

  • পরিবার: অভিভাবকত্ব, পরিবারিক পরিবেশ ও শৈশবের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ।
  • সংস্কৃতি: সামাজিক নিয়ম ও মূল্যবোধ ব্যক্তিত্ব গঠনে ভূমিকা রাখে।
  • বন্ধু ও সহপাঠী: বন্ধু-বান্ধব ও সামাজিক গোষ্ঠী সামাজিক দক্ষতা ও আত্ম-ধারণা গঠনে সহায়ক।

৪. পরিস্থিতিগত উপাদান

  • জীবন-অভিজ্ঞতা: বড় ধরনের ঘটনা যেমন—দুঃখ, সাফল্য বা ব্যর্থতা ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন করতে পারে।
  • শিক্ষা: নতুন কিছু শেখা ও অভিজ্ঞতা ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়ক।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যক্তিত্ব বোঝা ও পরিমাপ করা গুরুত্বপূর্ণ। প্রচলিত কিছু পদ্ধতি হলো—

১. স্ব-প্রতিবেদনমূলক প্রশ্নাবলি

  • উদাহরণ: মিনেসোটা মাল্টিফ্যাসিক পার্সোনালিটি ইনভেন্টরি (MMPI), NEO পার্সোনালিটি ইনভেন্টরি।
  • সুবিধা: সহজে নেওয়া ও স্কোর করা যায়।
  • অসুবিধা: উত্তরদাতার পক্ষপাত থাকতে পারে।

২. প্রজেক্টিভ টেস্ট

  • উদাহরণ: ররশাক ইঙ্কব্লট টেস্ট, থিম্যাটিক অ্যাপারসেপশন টেস্ট (TAT)।
  • সুবিধা: অবচেতন ব্যক্তিত্বের দিকগুলো উদ্ঘাটন করা যায়।
  • অসুবিধা: বিশ্লেষণ অনেক সময় ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে।

৩. পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি

  • প্রাকৃতিক বা নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে আচরণ পর্যবেক্ষণ করে ব্যক্তিত্ব নির্ধারণ।

৪. সাক্ষাৎকার

  • গঠিত বা অগঠিত পদ্ধতিতে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নেওয়া হয়।

ব্যক্তিত্ব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে:

১. ব্যক্তিগত মানিয়ে নেওয়া

  • ব্যক্তিত্ব নির্ধারণ করে ব্যক্তি কীভাবে চাপ সামলায়, পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেয় ও মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখে।

২. আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক

  • সহানুভূতি, মিশুকতা, সহযোগিতার মতো বৈশিষ্ট্য সম্পর্কের গুণগত মান নির্ধারণ করে।

৩. শিক্ষা ও পেশাগত সাফল্য

  • সংগঠিত ও নতুন কিছু শেখার আগ্রহ থাকা শিক্ষাগত ও পেশাগত সাফল্যের সঙ্গে সম্পর্কিত।

৪. মানসিক স্বাস্থ্য

  • উচ্চ নিউরোটিসিজমের মতো বৈশিষ্ট্য মানসিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়।

৫. নেতৃত্ব ও সামাজিক প্রভাব

  • আত্মবিশ্বাসী ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিরা সাধারণত ভালো নেতা ও প্রভাবশালী হন।

ব্যক্তিত্ব বিকাশ

ব্যক্তিত্ব জন্মগত নয়; এটি সারাজীবন বিকশিত হয়। প্রধান পর্যায় ও প্রভাবগুলো হলো—

১. শৈশব

  • প্রাথমিক অভিজ্ঞতা, অভিভাবকের সঙ্গে সংযোগ ও সামাজিকীকরণ গুরুত্বপূর্ণ।

২. কিশোরাবস্থা

  • পরিচয় গঠন, বন্ধুদের প্রভাব ও স্বাধীনতা ব্যক্তিত্ব গঠনে ভূমিকা রাখে।

৩. প্রাপ্তবয়স্ক জীবন

  • পেশা, বিবাহ, পিতামাতার ভূমিকা ও বড় ধরনের ঘটনা ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন আনে।

৪. বৃদ্ধ বয়স

  • জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ও প্রজ্ঞা বৃদ্ধির সময়।

ব্যক্তিত্ব পরিবর্তনের কারণ

যদিও ব্যক্তিত্ব সাধারণত স্থিতিশীল, তবে পরিবর্তিত হতে পারে—

  • বড় ধরনের জীবন-ঘটনা: দুঃখ, সাফল্য বা ব্যর্থতা।
  • চিকিৎসা ও আত্ম-পর্যালোচনা: মনস্তাত্ত্বিক সহায়তায় পরিবর্তন সম্ভব।
  • সংস্কৃতিগত পরিবর্তন: নতুন পরিবেশে গেলে বা নতুন মূল্যবোধের সংস্পর্শে এলে।

ব্যক্তিত্বের গঠন ও প্রকৃতি বোঝার জন্য মনোবিজ্ঞানে যে সমস্ত তত্ত্ব প্রচলিত আছে, তাদের মধ্যে ‘বিশেষত্ব বা লক্ষণ তত্ত্ব’ বা ‘Trait Theory’ অন্যতম প্রভাবশালী একটি তত্ত্ব। এই তত্ত্বের মূল কথা হলো, মানুষের ব্যক্তিত্ব কতগুলো মৌলিক, স্থিতিশীল এবং জন্মগত বা অর্জিত বৈশিষ্ট্য বা ‘ট্রেট’ (Trait) দ্বারা গঠিত। এই বিশেষত্বগুলোই বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষের আচরণ, চিন্তা এবং অনুভূতির মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় রাখে এবং এক ব্যক্তিকে অন্য ব্যক্তি থেকে আলাদা করে। উদাহরণস্বরূপ, সততা, উদারতা, অন্তর্মুখিতা, বহির্মুখিতা ইত্যাদি হলো এক-একটি ট্রেট বা বিশেষত্ব।

এই তত্ত্বটি ব্যক্তিত্বকে বর্ণনা এবং পরিমাপ করার উপর বেশি জোর দেয়, ব্যক্তিত্বের বিকাশের কারণ অনুসন্ধানের চেয়ে।

বিশেষত্ব তত্ত্বের বিকাশে বেশ কয়েকজন মনোবিজ্ঞানী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাদের মধ্যে প্রধান হলেন গর্ডন অলপোর্ট, রেমন্ড ক্যাটেল এবং হ্যান্স আইজেনক।

গর্ডন অলপোর্টকে বিশেষত্ব তত্ত্বের জনক বলা হয়। তিনি প্রথম নিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যক্তিত্বের বিশেষত্বগুলো নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি একটি ইংরেজি অভিধান থেকে প্রায় ১৮,০০০ শব্দ খুঁজে বের করেন যা মানুষের ব্যক্তিত্ব বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়। এই শব্দগুলোকে বিশ্লেষণ করে তিনি বিশেষত্বগুলোকে তিনটি প্রধান স্তরে ভাগ করেন:

  • ক) মূল বা প্রধান বিশেষত্ব (Cardinal Traits): এটি এমন একটি প্রভাবশালী বিশেষত্ব যা একজন ব্যক্তির সমগ্র জীবন এবং আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই ধরনের বিশেষত্ব খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। যেমন, মাদার টেরেজার ‘করুণা’ বা মহাত্মা গান্ধীর ‘অহিংসা’ ছিল তাদের কার্ডিনাল ট্রেট।
  • খ) কেন্দ্রীয় বিশেষত্ব (Central Traits): এগুলি হলো সেইসব সাধারণ বৈশিষ্ট্য যা দিয়ে একজন ব্যক্তিকে সহজেই বর্ণনা করা যায়। অলপোর্টের মতে, প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে প্রায় ৫ থেকে ১০টি কেন্দ্রীয় বিশেষত্ব থাকে, যা তার ব্যক্তিত্বের মূল গঠন তৈরি করে। যেমন: সৎ, বুদ্ধিমান, লাজুক, মিশুকে, দায়িত্বশীল ইত্যাদি।
  • গ) গৌণ বিশেষত্ব (Secondary Traits): এগুলি হলো কম গুরুত্বপূর্ণ এবং কম ধারাবাহিক বৈশিষ্ট্য, যা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতেই প্রকাশ পায়। যেমন, কোনো শান্ত মানুষ হয়তো যানজটে পড়লে অধৈর্য হয়ে পড়েন। এটি তার গৌণ বিশেষত্বের উদাহরণ।

রেমন্ড ক্যাটেল অলপোর্টের কাজকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান এবং ‘ফ্যাক্টর অ্যানালিসিস’ (Factor Analysis) নামক একটি পরিসংখ্যানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্যক্তিত্বের মূল উপাদানগুলো শনাক্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি মনে করতেন, ব্যক্তিত্বের মূল কাঠামো বোঝার জন্য বাহ্যিক আচরণের গভীরে যাওয়া প্রয়োজন। তিনি বিশেষত্বগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করেন:

  • ক) বাহ্যিক বিশেষত্ব (Surface Traits): এগুলি হলো সেইসব বৈশিষ্ট্য যা আমরা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে পারি। যেমন, বন্ধুত্বপরায়ণতা, আড্ডাবাজ ইত্যাদি।
  • খ) উৎস বিশেষত্ব (Source Traits): এগুলি হলো ব্যক্তিত্বের গভীরতর এবং মৌলিক উপাদান, যা বাহ্যিক বিশেষত্বগুলোর উৎস হিসেবে কাজ করে। ক্যাটেল গবেষণার মাধ্যমে ১৬টি মৌলিক উৎস বিশেষত্ব শনাক্ত করেন, যা ‘সিক্সটিন পার্সোনালিটি ফ্যাক্টর’ বা 16PF নামে পরিচিত। এর মধ্যে কয়েকটি হলো: উষ্ণতা (Warmth), যুক্তিবোধ (Reasoning), মানসিক স্থিতি (Emotional Stability), আধিপত্য (Dominance), সামাজিক সাহস (Social Boldness) ইত্যাদি।

হ্যান্স আইজেনক একটি অপেক্ষাকৃত সরল মডেল প্রস্তাব করেন। তিনি মনে করতেন যে ব্যক্তিত্বের মূল কাঠামো মাত্র কয়েকটি ‘সুপার-ট্রেট’ বা মাত্রার (Dimension) উপর ভিত্তি করে গঠিত। তিনি বংশগতি ও জৈবিক কারণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। তার মডেলে তিনটি প্রধান মাত্রা রয়েছে:

  • ক) বহির্মুখিতা বনাম অন্তর্মুখিতা (Extraversion vs. Introversion): বহির্মুখী ব্যক্তিরা মিশুকে, সামাজিক, উত্তেজনা পছন্দ করেন। অন্যদিকে, অন্তর্মুখী ব্যক্তিরা শান্ত, লাজুক, একাকী থাকতে পছন্দ করেন। আইজেনকের মতে, মস্তিষ্কের কর্টিকাল অ্যারাইজাল (cortical arousal) বা উত্তেজনার মাত্রার উপর এটি নির্ভরশীল।
  • খ) স্নায়বিকতা বনাম মানসিক স্থিতিশীলতা (Neuroticism vs. Emotional Stability): স্নায়বিকতার দিকে থাকা ব্যক্তিরা উদ্বিগ্ন, বিষণ্ণ এবং আবেগপ্রবণ হন। অন্যদিকে, মানসিক স্থিতিশীল ব্যক্তিরা শান্ত ও ধীর-স্থির প্রকৃতির হন। এটি স্বায়ত্তশাসিত স্নায়ুতন্ত্রের (autonomic nervous system) প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল।
  • গ) মনস্তাত্ত্বিকতা বনাম সামাজিকীকরণ (Psychoticism vs. Socialisation): এই মাত্রাটি তিনি পরে যোগ করেন। মনস্তাত্ত্বিকতার দিকে থাকা ব্যক্তিরা আগ্রাসী, আবেগহীন এবং সামাজিক নিয়মের প্রতি উদাসীন হন। অন্যদিকে, বিপরীত মেরুর ব্যক্তিরা সহানুভূতিশীল ও সহযোগিতাপূর্ণ হন।

বর্তমানে ব্যক্তিত্বের বিশেষত্ব তত্ত্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বহুল স্বীকৃত মডেল হলো ‘পঞ্চ-উপাদান মডেল’ বা ‘বিগ ফাইভ’। বহু গবেষকের কাজের উপর ভিত্তি করে এই মডেলটি তৈরি হয়েছে এবং এটি সংস্কৃতি নির্বিশেষে প্রযোজ্য বলে মনে করা হয়। এই পাঁচটি প্রধান বিশেষত্ব হলো:

  1. অভিজ্ঞতার প্রতি উন্মুক্ততা (Openness to Experience): কল্পনাপ্রবণ, সৃজনশীল, কৌতূহলী বনাম বাস্তববাদী, রুটিনমাফিক।
  2. কর্তব্যপরায়ণতা (Conscientiousness): সুশৃঙ্খল, দায়িত্ববান, পরিশ্রমী বনাম বিশৃঙ্খল, অমনোযোগী, আবেগতাড়িত।
  3. বহির্মুখিতা (Extraversion): সামাজিক, মিশুকে, কর্মচঞ্চল বনাম লাজুক, শান্ত, সংরক্ষিত।
  4. সহমততা (Agreeableness): সহানুভূতিশীল, সহযোগিতাপূর্ণ, বিশ্বাসী বনাম সন্দেহপ্রবণ, অসহযোগী, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ।
  5. স্নায়বিকতা (Neuroticism): উদ্বিগ্ন, নিরাপত্তাহীন, আবেগপ্রবণ বনাম শান্ত, সুরক্ষিত, স্থিতিশীল।

শক্তি:

  • বস্তুনিষ্ঠতা: এই তত্ত্ব ব্যক্তিত্বকে পরিমাপযোগ্য ও বস্তুনিষ্ঠভাবে বর্ণনা করার একটি কাঠামো প্রদান করে।
  • ব্যবহারিক প্রয়োগ: কর্মী নিয়োগ, কর্মজীবনের পরামর্শ এবং মানসিক রোগ নির্ণয়ে এই তত্ত্বের ব্যাপক প্রয়োগ রয়েছে।
  • সহজবোধ্যতা: ব্যক্তিত্বের জটিল ধারণাকে কয়েকটি মূল বিশেষত্বের মাধ্যমে সহজে বোঝা যায়।

দুর্বলতা:

  • বর্ণনামূলক, ব্যাখ্যামূলক নয়: এই তত্ত্ব ব্যক্তিত্বের ‘কী’ (what) তা বর্ণনা করে, কিন্তু ‘কেন’ (why) বা ‘কীভাবে’ (how) ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে, তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেয় না।
  • পরিস্থিতির ভূমিকা উপেক্ষা: এই তত্ত্ব ব্যক্তিত্বের স্থিতিশীলতার উপর বেশি জোর দেয়, কিন্তু পরিস্থিতি বদলের সাথে সাথে মানুষের আচরণ যে বদলে যায় (Person-Situation Debate), সেই দিকটি অনেক সময় উপেক্ষা করে।
  • অতিসরলীকরণ: ব্যক্তিত্বের মতো একটি জটিল বিষয়কে কয়েকটি বিশেষত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা এক ধরনের অতিসরলীকরণ বলে অনেক মনোবিজ্ঞানী মনে করেন।

কিছু সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, ব্যক্তিত্বের বিশেষত্ব বা লক্ষণ তত্ত্ব মনোবিজ্ঞানের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে কেন মানুষ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তুলনামূলকভাবে একই রকম আচরণ করে এবং কীভাবে আমরা মানুষের ব্যক্তিত্বের একটি সাধারণ কাঠামো তৈরি করতে পারি। ‘বিগ ফাইভ’ মডেলের মতো আধুনিক সংস্করণগুলো ব্যক্তিত্ব গবেষণায় একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করেছে এবং আজও এর প্রাসঙ্গিকতা অটুট।

Similar Posts