ভূমিকা
শিক্ষাদর্শনের ইতিহাসে প্রয়োগবাদ (Pragmatism) একটি বৈপ্লবিক চিন্তাধারা, যা বিংশ শতাব্দীর শুরুতে শিক্ষাব্যবস্থাকে এক নতুন পথে চালিত করেছিল। গ্রিক শব্দ ‘Pragma’ থেকে এই দর্শনের নামকরণ হয়েছে, যার অর্থ হলো ‘কর্ম’ বা ‘কাজ’। সুতরাং, প্রয়োগবাদ হলো সেই দর্শন যা তত্ত্বের চেয়ে কর্ম, চিন্তার চেয়ে প্রয়োগ এবং বিমূর্ত ধারণার চেয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে। চার্লস স্যান্ডার্স পিয়ার্স, উইলিয়াম জেমস এবং সর্বোপরি জন ডিউই-এর মতো দার্শনিকদের হাত ধরে এই চিন্তাধারা বিকশিত হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে জন ডিউই-এর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি শিক্ষাকে জীবনের প্রস্তুতি হিসেবে না দেখে, জীবনযাপনের একটি প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখেছেন।
প্রয়োগবাদ অনুসারে, জ্ঞান স্থির বা শাশ্বত কোনো বিষয় নয়; এটি পরিবর্তনশীল এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত হয়। যা কিছু আমাদের জীবনে কার্যকরী, যা সমস্যার সমাধানে সহায়ক এবং যা আমাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, তাই সত্য এবং মূল্যবান। এই দর্শনের মূল ভিত্তি হলো উপযোগিতা, অভিজ্ঞতা এবং পরিবর্তনশীলতা। এই প্রবন্ধে প্রয়োগবাদের মূল নীতিগুলির উপর ভিত্তি করে শিক্ষণ পদ্ধতি এবং শিক্ষকের ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
প্রয়োগবাদী শিক্ষাদর্শনের মূল নীতি
শিক্ষণ পদ্ধতি ও শিক্ষকের ভূমিকা বোঝার আগে প্রয়োগবাদের কয়েকটি মূল নীতি সম্পর্কে ধারণা থাকা আবশ্যক।
১. বাস্তবতা পরিবর্তনশীল: প্রয়োগবাদীরা মনে করেন, জগৎ বা বাস্তবতা কোনো স্থির সত্তা নয়। এটি ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই জ্ঞানও চূড়ান্ত বা চিরন্তন হতে পারে না।
২. অভিজ্ঞতার উপর গুরুত্ব: জ্ঞানার্জনের প্রধান উৎস হলো অভিজ্ঞতা। মানুষ তার পারিপার্শ্বিক জগতের সাথে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমেই শেখে। ‘Learning by doing’ বা হাতে-কলমে শিক্ষা এই দর্শনের মূলমন্ত্র।
৩. উপযোগিতার নীতি: কোনো ধারণা বা কাজের সত্যতা তার উপযোগিতা বা কার্যকারিতার উপর নির্ভরশীল। যে জ্ঞান বা শিক্ষা শিক্ষার্থীর বাস্তব জীবনে কোনো কাজে লাগে না, তা অর্থহীন।
৪. সমস্যা সমাধান: জীবন মানেই একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হওয়া। শিক্ষা শিক্ষার্থীকে সেই সমস্যাগুলি চিহ্নিত করতে এবং তা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করবে।
৫. সামাজিক প্রেক্ষাপট: মানুষ একটি সামাজিক জীব। তাই শিক্ষাকে অবশ্যই সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হবে। বিদ্যালয় হলো সমাজের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ (Miniature Society), যেখানে শিশুরা সামাজিক জীবনযাপনের অনুশীলন করবে।
৬. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ: প্রয়োগবাদ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। শিক্ষাব্যবস্থায় স্বাধীনতা, সাম্য, সহযোগিতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার মতো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিফলন থাকা উচিত।
প্রয়োগবাদের আলোকে শিক্ষণ পদ্ধতি (Methods of Teaching in Pragmatism)
প্রয়োগবাদ প্রচলিত পুঁথিগত, শিক্ষক-কেন্দ্রিক এবং বক্তৃতা-নির্ভর শিক্ষণ পদ্ধতির তীব্র বিরোধী। এই দর্শন এমন শিক্ষণ পদ্ধতির কথা বলে যা হবে শিশুকেন্দ্রিক, কর্মভিত্তিক এবং জীবনমুখী। নিচে প্রয়োগবাদ সমর্থিত প্রধান শিক্ষণ পদ্ধতিগুলি আলোচনা করা হলো:
১. প্রকল্প পদ্ধতি (Project Method)
প্রয়োগবাদী শিক্ষণ পদ্ধতির সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো প্রকল্প পদ্ধতি। জন ডিউই-এর ভাবশিষ্য উইলিয়াম কিলপ্যাট্রিক এই পদ্ধতির প্রবক্তা। প্রকল্প হলো একটি উদ্দেশ্যমূলক কাজ, যা সামাজিক পরিবেশে আন্তরিকভাবে সম্পন্ন করা হয়। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনের সাথে সম্পর্কিত কোনো একটি সমস্যা বা কাজকে প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা সমাধানে উদ্যোগী হয়।
প্রকল্প পদ্ধতির বিভিন্ন স্তর:
- পরিস্থিতি সৃষ্টি (Creating a Situation): শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেন যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা কোনো একটি প্রকল্প বেছে নিতে আগ্রহী হয়। যেমন—বিদ্যালয়ে একটি বাগান তৈরি করা, একটি বার্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করা বা এলাকার জলদূষণ নিয়ে একটি সমীক্ষা চালানো।
- প্রকল্প নির্বাচন (Choosing the Project): শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের সহায়তায় নিজেদের আগ্রহ ও ক্ষমতা অনুযায়ী একটি প্রকল্প নির্বাচন করে। এই নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে।
- পরিকল্পনা (Planning): প্রকল্পটি কীভাবে সম্পন্ন করা হবে, তার জন্য শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে একটি বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে। কী কী উপকরণ লাগবে, কে কোন দায়িত্ব পালন করবে, কত সময় লাগবে—এইসব বিষয়ে তারা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়।
- কার্য সম্পাদন (Executing): শিক্ষার্থীরা পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্পটি বাস্তবে রূপায়ণ করে। এই স্তরে তারা হাতে-কলমে কাজ করে এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখে। শিক্ষক এখানে একজন সহায়কের ভূমিকা পালন করেন।
- মূল্যায়ন (Evaluation): কাজ শেষ হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা তাদের কাজের মূল্যায়ন করে। তারা বিচার করে দেখে, তাদের উদ্দেশ্য কতটা সফল হয়েছে এবং কাজের মধ্যে কী কী ভুলত্রুটি ছিল। এই আত্মসমালোচনা তাদের ভবিষ্যৎ কাজের জন্য প্রস্তুত করে।
- লিপিবদ্ধকরণ (Recording): সবশেষে, শিক্ষার্থীরা প্রকল্পের প্রতিটি ধাপ, তাদের অভিজ্ঞতা এবং ফলাফল বিস্তারিতভাবে লিখে রাখে।
এই পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, সৃজনশীলতা, সহযোগিতার মনোভাব এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।
২. সমস্যা সমাধান পদ্ধতি (Problem-Solving Method)
এই পদ্ধতিটিও প্রয়োগবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের সামনে একটি বাস্তব সমস্যা তুলে ধরা হয় এবং তাদের সেই সমস্যাটি বৈজ্ঞানিক উপায়ে সমাধান করতে উৎসাহিত করা হয়।
সমস্যা সমাধান পদ্ধতির স্তর:
- সমস্যাটি সম্পর্কে সচেতন হওয়া।
- সমস্যাটি স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা।
- সমস্যা সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা।
- সম্ভাব্য সমাধানগুলি (Hypothesis) অনুমান করা।
- সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সমাধানটি পরীক্ষা করা।
- সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া।
এই পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যৌক্তিক চিন্তন, বিশ্লেষণ ক্ষমতা এবং স্বাধীনভাবে জ্ঞান অর্জনের দক্ষতা গড়ে ওঠে।
৩. হাতে–কলমে শিক্ষা বা কর্মভিত্তিক শিক্ষা (Learning by Doing)
প্রয়োগবাদের মূল কথাই হলো কর্মের মাধ্যমে শিক্ষা। এই দর্শন অনুযায়ী, শিশুরা কেবল শুনে বা পড়ে যা শেখে, তার চেয়ে অনেক বেশি শেখে নিজেরা কিছু করে। তাই শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাকে পরীক্ষাগার, কর্মশালা বা বাস্তব জগতের কাজের সঙ্গে যুক্ত করা উচিত। ভূগোল পড়ানোর সময় মানচিত্র আঁকা, বিজ্ঞান পড়ানোর সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা বা ইতিহাস পড়ানোর সময় ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন করা—এই সবই কর্মভিত্তিক শিক্ষার উদাহরণ।
৪. সমন্বয় পদ্ধতি (Integration Method)
প্রয়োগবাদীরা জ্ঞানের কৃত্রিম বিভাজনের বিরোধী। তারা মনে করেন, জ্ঞান একটি অখণ্ড সত্তা। তাই বিভিন্ন বিষয়কে আলাদা আলাদা করে না শিখিয়ে, একটি সমন্বিত (Integrated) উপায়ে শেখানো উচিত। প্রকল্প পদ্ধতির মাধ্যমে খুব সহজেই এই সমন্বয় সাধন করা যায়। যেমন—একটি বাগান তৈরির প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যুগপৎভাবে জীববিজ্ঞান (গাছের বৃদ্ধি), গণিত (জমির পরিমাপ), রসায়ন (সারের ব্যবহার), ভাষা (প্রকল্পের বিবরণ লেখা) এবং সমাজবিদ্যা (দলবদ্ধভাবে কাজ করা) সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে।
৫. সামাজিকীকৃত পদ্ধতি (Socialized Method)
যেহেতু বিদ্যালয় সমাজেরই একটি ক্ষুদ্র প্রতিরূপ, তাই শিক্ষণ পদ্ধতিও হবে সামাজিক। দলগত আলোচনা (Group Discussion), বিতর্ক (Debate), কর্মশালা (Workshop) এবং বিভিন্ন সহযোগিতামূলক কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা একে অপরের কাছ থেকে শেখে। এর ফলে তাদের মধ্যে সামাজিক গুণাবলি, যেমন—সহিষ্ণুতা, নেতৃত্ব এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে ওঠে।
প্রয়োগবাদের আলোকে শিক্ষকের ভূমিকা (Role of Teacher in Pragmatism)
প্রয়োগবাদী শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের ভূমিকা প্রচলিত ব্যবস্থার মতো সর্বেসর্বা বা জ্ঞানদাতার নয়। এখানে শিক্ষক হলেন একজন বন্ধু, দার্শনিক এবং পথপ্রদর্শক (Friend, Philosopher, and Guide)। তার ভূমিকা বহুমুখী এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১. বন্ধু (Friend):
প্রয়োগবাদী শিক্ষক একজন স্বৈরাচারী শাসক নন, বরং তিনি শিক্ষার্থীদের বন্ধু। তিনি এমন একটি সহজ ও ভয়মুক্ত পরিবেশ তৈরি করেন যেখানে শিক্ষার্থীরা নির্দ্বিধায় তাদের সমস্যা, প্রশ্ন এবং মতামত প্রকাশ করতে পারে। তিনি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ, ক্ষমতা এবং দুর্বলতাগুলি সহানুভূতির সাথে বোঝার চেষ্টা করেন এবং তাদের পাশে থেকে উৎসাহিত করেন।
২. পথপ্রদর্শক ও সহায়ক (Guide and Facilitator):
শিক্ষকের প্রধান কাজ জ্ঞান পরিবেশন করা নয়, বরং শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনের পথে সহায়তা করা। তিনি শিক্ষার্থীদের সামনে বিভিন্ন সমস্যা বা পরিস্থিতি তুলে ধরেন এবং তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করতে পথ দেখান। তিনি সরাসরি উত্তর বলে দেন না, বরং সঠিক প্রশ্ন করে, প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করে এবং আলোচনা সংগঠিত করে শিক্ষার্থীদের চিন্তাকে উসকে দেন। তিনি একজন ‘Facilitator’, যিনি শেখার প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলেন।
৩. অভিজ্ঞতার সংগঠক (Organizer of Experiences):
প্রয়োগবাদী শিক্ষকের একটি বড় দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা আয়োজন করা। কোন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে ভালোভাবে শিখতে পারবে, তা তাকে ভাবতে হয়। তিনি শ্রেণিকক্ষকে একটি পরীক্ষাগারে পরিণত করেন, যেখানে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রকল্প ও কাজের মাধ্যমে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে। শিক্ষামূলক ভ্রমণ, কর্মশালা বা বাস্তব জগতের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন কার্যকলাপের পরিকল্পনা ও আয়োজন করা তার অন্যতম দায়িত্ব।
৪. গণতান্ত্রিক নেতা (Democratic Leader):
শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের পরিচালক, কিন্তু তিনি স্বৈরাচারী নন। তিনি একজন গণতান্ত্রিক নেতা। তিনি শ্রেণিকক্ষের নিয়মকানুন তৈরিতে শিক্ষার্থীদের মতামত গ্রহণ করেন এবং যাবতীয় কাজে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেন। তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহযোগিতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং দায়িত্ববোধের মতো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলেন।
৫. সমস্যা সৃষ্টিকারী (Problem-Setter):
প্রয়োগবাদী শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাসঙ্গিক এবং অর্থপূর্ণ সমস্যা তৈরি করেন। তিনি এমন সব প্রশ্ন বা পরিস্থিতি তৈরি করেন যা শিক্ষার্থীদের চিন্তা করতে বাধ্য করে এবং তাদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা জাগিয়ে তোলে। এই সমস্যা সমাধানের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা নতুন জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করে।
৬. পরামর্শদাতা (Counselor):
শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ও শিক্ষাগত সমস্যা সমাধানে একজন পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করেন। তিনি তাদের আগ্রহ, প্রবণতা এবং ক্ষমতা চিহ্নিত করে ভবিষ্যতের জন্য সঠিক পথ বেছে নিতে সহায়তা করেন।
৭. সামাজিক প্রকৌশলী (Social Engineer):
যেহেতু বিদ্যালয় হলো সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ, তাই শিক্ষক হলেন একজন সামাজিক প্রকৌশলী। তিনি শ্রেণিকক্ষে এমন একটি সামাজিক পরিবেশ তৈরি করেন যা শিশুদের ভবিষ্যৎ সামাজিক জীবনের জন্য প্রস্তুত করে। তিনি সহযোগিতামূলক এবং গণতান্ত্রিক একটি সমাজ গঠনে সহায়তা করেন।
উপসংহার
প্রয়োগবাদ শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি নতুন দিশা দেখিয়েছে। এটি শিক্ষাকে গতানুগতিক, নীরস এবং জীবনবিচ্ছিন্ন একটি প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত করে তাকে একটি জীবন্ত, আনন্দময় এবং অর্থপূর্ণ কার্যকলাপে পরিণত করেছে। প্রয়োগবাদের আলোকে শিক্ষণ পদ্ধতিগুলি শিক্ষার্থীকে সক্রিয় জ্ঞান নির্মাণকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে এবং তার সৃজনশীলতা, আত্মবিশ্বাস ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতাকে বিকশিত করে।
এই দর্শনে শিক্ষকের ভূমিকাও আমূল পরিবর্তিত হয়েছে। তিনি আর জ্ঞানের একমাত্র উৎস নন, বরং তিনি হয়ে উঠেছেন শেখার পরিবেশের একজন সংগঠক, একজন সহায়ক এবং শিক্ষার্থীদের সহযাত্রী। তাঁর কাজ হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলা এবং তাদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে ও কাজ করতে উৎসাহিত করা।
আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় যে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা, কর্মভিত্তিক পাঠ্যক্রম, প্রকল্প-নির্ভর শিখন (Project-Based Learning) এবং গঠনবাদ (Constructivism)-এর উপর জোর দেওয়া হয়, তার মূলে রয়েছে প্রয়োগবাদী চিন্তাধারার গভীর প্রভাব। যদিও প্রয়োগবাদের কিছু সীমাবদ্ধতা (যেমন—আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধের উপর কম গুরুত্ব আরোপ) নিয়ে সমালোচনা রয়েছে, তবুও একটি গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল এবং কার্যকরী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জন ডিউই এবং প্রয়োগবাদী দর্শনের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।