শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হলো পাঠ্যক্রম বা Curriculum। এটি শুধুমাত্র একটি পাঠ্যসূচি বা বিষয়বস্তুর তালিকা নয়, বরং একটি সুসংহত পরিকল্পনা যা শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশের লক্ষ্যে প্রণয়ন করা হয়। পাঠ্যক্রম হলো সেই পথ, যা অনুসরণ করে শিক্ষা তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছায়। এই পথের প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি পদক্ষেপ নির্ধারিত হয় কিছু মৌলিক নীতির উপর ভিত্তি করে। এই ভিত্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হলো মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি।
পাঠ্যক্রম কাদের জন্য? এর উত্তর অত্যন্ত সহজ—শিক্ষার্থীদের জন্য। আর এই শিক্ষার্থীদের মন, তাদের শিখন প্রক্রিয়া, আগ্রহ, ক্ষমতা, আবেগ, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং বিকাশের বিভিন্ন স্তরকে বৈজ্ঞানিকভাবে অনুধাবন করার শাস্ত্রই হলো মনোবিজ্ঞান। সুতরাং, পাঠ্যক্রম প্রণয়নের সময় মনোবিজ্ঞানের ও তত্ত্বগুলোকে উপেক্ষা করার অর্থ হলো, যে শিক্ষার্থীর জন্য এই আয়োজন, তাকেই অস্বীকার করা। একটি কার্যকর ও যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম অবশ্যই শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক হবে এবং তার মনস্তাত্ত্বিক চাহিদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে।
মনোবিজ্ঞান আমাদের শেখায় যে, শিশুরা কীভাবে শেখে (How children learn), কেন শেখে (Why they learn), এবং কোন পরিস্থিতিতে তাদের শিখন সবচেয়ে ফলপ্রসূ হয় (Under what conditions they learn best)। এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই পাঠ্যক্রমের রূপরেখা তৈরি করে দেয়। পাঠ্যক্রমের উদ্দেশ্য নির্ধারণ, বিষয়বস্তু নির্বাচন, শিখন-অভিজ্ঞতার সংগঠন এবং মূল্যায়নের পদ্ধতি—এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই মনোবিজ্ঞানের গভীর প্রভাব রয়েছে। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি ছাড়া পাঠ্যক্রম প্রণয়নের কথা চিন্তাই করা যায় না।
এই প্রবন্ধে আমরা পাঠ্যক্রমের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিগুলোকে বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করব। মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা, যেমন—আচরণবাদ (Behaviorism), জ্ঞানমূলক মতবাদ (Cognitivism), নির্মাণবাদ (Constructivism), মানবতাবাদ (Humanism) এবং বিকাশমূলক মনোবিজ্ঞান (Developmental Psychology) কীভাবে পাঠ্যক্রমকে প্রভাবিত করে, তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা করা হবে।
১. মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন মতবাদ এবং পাঠ্যক্রমে তাদের প্রভাব:
পাঠ্যক্রমের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি কোনো একক তত্ত্বের উপর নির্ভরশীল নয়। মনোবিজ্ঞানের ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মতবাদ প্রভাবশালী হয়েছে এবং প্রতিটি মতবাদই পাঠ্যক্রমের উপর নিজস্ব ছাপ রেখে গেছে। নিম্নে প্রধান মতবাদগুলোর আলোচনা করা হলো:
ক) আচরণবাদ (Behaviorism) ও পাঠ্যক্রম:
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মনোবিজ্ঞানের জগতে আচরণবাদ এক প্রভাবশালী মতবাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জন বি. ওয়াটসন, ইভান প্যাভলভ, এডওয়ার্ড থর্নডাইক এবং বি. এফ. স্কিনারের মতো মনোবিজ্ঞানীরা এই মতবাদের প্রধান প্রবক্তা। আচরণবাদের মূল কথা হলো, শিখন হলো আচরণের পরিবর্তন, যা উদ্দীপক (Stimulus) এবং প্রতিক্রিয়ার (Response) মধ্যে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে ঘটে। তাদের মতে, শিক্ষার্থীর অভ্যন্তরীণ মানসিক প্রক্রিয়া (যেমন—চিন্তা, অনুভূতি) পর্যবেক্ষণযোগ্য নয়, তাই বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনার জন্য শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণের উপরই গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
আচরণবাদের মূল নীতি:
- অনুবর্তন (Conditioning): প্যাভলভের ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিং এবং স্কিনারের অপারেন্ট কন্ডিশনিং—এই দুই ধরনের অনুবর্তন আচরণের পরিবর্তনে মূল ভূমিকা পালন করে।
- উদ্দীপক-প্রতিক্রিয়া সংযোগ (S-R Bond): শিখন হলো নির্দিষ্ট উদ্দীপকের প্রতি নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া করার অভ্যাস গঠন।
- বলবর্ধক বা পুরস্কার (Reinforcement): সঠিক প্রতিক্রিয়ার পর ইতিবাচক বলবর্ধক (Positive Reinforcement) বা পুরস্কার প্রদান করলে সেই আচরণটি শক্তিশালী হয় এবং পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা বাড়ে। নেতিবাচক বলবর্ধক (Negative Reinforcement) সরিয়ে নিলেও আচরণ শক্তিশালী হয়। শাস্তি (Punishment) অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণকে দমন করতে ব্যবহৃত হয়।
- অনুশীলন ও পুনরাবৃত্তি (Drill and Practice): থর্নডাইকের ‘Law of Exercise’ অনুযায়ী, বারবার অনুশীলনের মাধ্যমে উদ্দীপক-প্রতিক্রিয়া সংযোগ দৃঢ় হয়।
পাঠ্যক্রমে আচরণবাদের প্রভাব:
- উদ্দেশ্য নির্ধারণ (Objectives): আচরণবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠ্যক্রমের উদ্দেশ্যগুলো সুনির্দিষ্ট, পরিমাপযোগ্য এবং পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণের নিরিখে নির্ধারণ করা হয়। যেমন: “শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পাঁচটি কারণ তালিকাভুক্ত করতে পারবে।” এখানে ‘তালিকাভুক্ত করতে পারা’ একটি পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণ। রবার্ট মেগারের (Robert Mager) আচরণগত উদ্দেশ্য লেখার পদ্ধতি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
- বিষয়বস্তু বিন্যাস (Content Organization): বিষয়বস্তুকে ছোট ছোট অংশে (units) ভাগ করা হয় এবং সরল থেকে জটিলের দিকে ধাপে ধাপে উপস্থাপন করা হয়। একে টাস্ক অ্যানালাইসিস (Task Analysis) বলা হয়। স্কিনারের প্রোগ্রামড লার্নিং (Programmed Learning) এই নীতির উপর ভিত্তি করেই তৈরি, যেখানে প্রতিটি সঠিক উত্তরের জন্য তাৎক্ষণিক ফিডব্যাক বা পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকে।
- শিখন পদ্ধতি (Learning Strategies): আচরণবাদী পাঠ্যক্রমে শিক্ষকই জ্ঞানের প্রধান উৎস। তিনি বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেন এবং শিক্ষার্থীরা তা গ্রহণ করে। এখানে ড্রিল, অনুশীলন, পুনরাবৃত্তি এবং মুখস্থ করার উপর জোর দেওয়া হয়। শিক্ষকের প্রধান কাজ হলো সঠিক আচরণকে পুরস্কৃত করা এবং ভুল আচরণকে সংশোধন করা।
- মূল্যায়ন (Evaluation): মূল্যায়ন পদ্ধতি মূলত পরিমাণগত (Quantitative) হয়। নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন (Objective tests), যেমন—MCQ, সত্য-মিথ্যা নির্ণয়, শূন্যস্থান পূরণ ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শিখন পরিমাপ করা হয়, কারণ এগুলো সহজেই পরিমাপযোগ্য।
সমালোচনা: আচরণবাদ শিখন প্রক্রিয়াকে অতিরিক্ত সরলীকরণ করে এবং একে একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখে। এটি শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা, চিন্তন ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং অভ্যন্তরীণ মানসিক প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, যা আধুনিক শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য।
খ) জ্ঞানমূলক মতবাদ (Cognitivism) ও পাঠ্যক্রম:
১৯৫০-এর দশকের পর থেকে আচরণবাদের যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিক্রিয়া হিসেবে জ্ঞানমূলক মতবাদের উদ্ভব হয়। জ্ঞানমূলক মনোবিজ্ঞানীরা শিখনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর অভ্যন্তরীণ মানসিক প্রক্রিয়া, যেমন—চিন্তন, স্মৃতি, প্রত্যক্ষণ, সমস্যা সমাধান, এবং তথ্য প্রক্রিয়াকরণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁরা মনকে একটি কম্পিউটারের সঙ্গে তুলনা করেন, যা তথ্য গ্রহণ করে, প্রক্রিয়াকরণ করে, সংরক্ষণ করে এবং প্রয়োজনে পুনরুদ্ধার করে। জ্যাঁ পিয়াজে (Jean Piaget), জেরোম ব্রুনার (Jerome Bruner), ডেভিড Ausubel এবং গেস্টাল্ট মনোবিজ্ঞানীরা এই ধারার প্রধান প্রবক্তা।
জ্ঞানমূলক মতবাদের মূল নীতি:
- তথ্য প্রক্রিয়াকরণ (Information Processing): শিখন হলো একটি সক্রিয় মানসিক প্রক্রিয়া যেখানে শিক্ষার্থী তথ্য গ্রহণ করে, সেটিকে সংগঠিত করে, পূর্ববর্তী জ্ঞানের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং স্মৃতিতে সঞ্চয় করে।
- জ্ঞানীয় কাঠামো (Cognitive Structure): শিক্ষার্থীর মনে জ্ঞানের একটি সুসংগঠিত কাঠামো বা স্কিমা (Schema) থাকে। নতুন জ্ঞান এই কাঠামোর সাথে যুক্ত হয়েই অর্থপূর্ণ হয়।
- অন্তর্দৃষ্টি (Insight): গেস্টাল্ট মনোবিজ্ঞানীদের মতে, শিখন নিছক যান্ত্রিক প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে হয় না, বরং সমস্যার সামগ্রিক রূপ প্রত্যক্ষণ করার মাধ্যমে হঠাৎ করেই সমাধান বা অন্তর্দৃষ্টি লাভ হয়।
- আবিষ্কারমূলক শিখন (Discovery Learning): জেরোম ব্রুনারের মতে, শিক্ষার্থীদের সরাসরি জ্ঞান প্রদান না করে তাদের অনুসন্ধানের মাধ্যমে 스스로 জ্ঞান আবিষ্কার করতে উৎসাহিত করা উচিত।
পাঠ্যক্রমে জ্ঞানমূলক মতবাদের প্রভাব:
- উদ্দেশ্য নির্ধারণ: উদ্দেশ্যগুলো শুধুমাত্র বাহ্যিক আচরণের উপর সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং বোধগম্যতা (understanding), প্রয়োগ (application), বিশ্লেষণ (analysis), এবং সমস্যা সমাধানের মতো উচ্চতর মানসিক দক্ষতার বিকাশের উপর জোর দেওয়া হয়।
- বিষয়বস্তু নির্বাচন ও বিন্যাস: বিষয়বস্তু এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয় যা শিক্ষার্থীদের জ্ঞানীয় কাঠামোর বিকাশে সহায়তা করে।
- ব্রুনারের সর্পিল পাঠ্যক্রম (Spiral Curriculum): এই ধারণায়, একই বিষয়বস্তু বিভিন্ন শ্রেণিতে ক্রমবর্ধমান জটিলতা ও গভীরতার সাথে বারবার উপস্থাপন করা হয়। যেমন—প্রাথমিক স্তরে পরমাণুর সরল ধারণা এবং উচ্চস্তরে তার জটিল গঠন ও কোয়ান্টাম মডেল আলোচনা করা।
- অসুবেলের অর্থপূর্ণ শিখন (Meaningful Learning): অসুবেলের মতে, নতুন জ্ঞানকে শিক্ষার্থীর পূর্ববর্তী জ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত করতে পারলে শিখন অর্থপূর্ণ হয়। এর জন্য তিনি ‘অ্যাডভান্স অর্গানাইজার’ (Advance Organizer) ব্যবহারের কথা বলেন, যা পাঠের শুরুতে একটি ভূমিকা হিসেবে কাজ করে এবং নতুন ও পুরনো জ্ঞানের মধ্যে সেতু তৈরি করে।
- শিখন পদ্ধতি: শিক্ষক এখানে একজন সহায়কের (Facilitator) ভূমিকা পালন করেন। তিনি শিক্ষার্থীদের চিন্তা করতে, প্রশ্ন করতে এবং সমস্যা সমাধানে উৎসাহিত করেন। আলোচনা, বিতর্ক, মাইন্ড ম্যাপিং, কনসেপ্ট ম্যাপিং, এবং সমস্যাভিত্তিক শিখনের মতো পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
- মূল্যায়ন: মূল্যায়ন শুধুমাত্র মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে শিক্ষার্থীর বোধগম্যতা, প্রয়োগ ক্ষমতা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা পরিমাপের উপর গুরুত্ব দেয়। বর্ণনামূলক প্রশ্ন, কেস স্টাডি, এবং সমস্যা সমাধানমূলক কাজ মূল্যায়নের অংশ হয়।
গ) নির্মাণবাদ বা গঠনবাদ (Constructivism) ও পাঠ্যক্রম:
নির্মাণবাদ জ্ঞানমূলক মতবাদেরই একটি প্রসারিত ও আধুনিক রূপ। এর মূল কথা হলো, জ্ঞান বাইরে থেকে শিক্ষার্থীর মনে প্রবেশ করানো যায় না; বরং শিক্ষার্থী তার নিজের অভিজ্ঞতা ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে জ্ঞান নির্মাণ করে। অর্থাৎ, শিক্ষার্থী জ্ঞানের নিষ্ক্রিয় গ্রাহক নয়, সে জ্ঞানের সক্রিয় নির্মাতা। জ্যাঁ পিয়াজে (Jean Piaget), লেভ ভাইগটস্কি (Lev Vygotsky), জন ডিউই (John Dewey) এই মতবাদের সাথে যুক্ত।
নির্মাণবাদের মূল নীতি:
- জ্ঞানের সক্রিয় নির্মাণ (Active Construction of Knowledge): শিক্ষার্থীরা তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং নতুন তথ্যের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে নিজস্ব অর্থ বা জ্ঞান তৈরি করে।
- শিখনের সামাজিক প্রেক্ষিত (Social Context of Learning): ভাইগটস্কির মতে, শিখন একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। অন্যের সাথে (যেমন—শিক্ষক, সহপাঠী) পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও সহযোগিতার মাধ্যমে জ্ঞান নির্মিত হয়।
- বাস্তবভিত্তিক ও প্রাসঙ্গিক শিখন (Authentic and Contextualized Learning): শিখন যখন বাস্তব জীবনের সমস্যা বা পরিস্থিতির সাথে যুক্ত থাকে, তখন তা সবচেয়ে বেশি কার্যকর ও অর্থপূর্ণ হয়।
- ZPD এবং স্ক্যাফোল্ডিং (Zone of Proximal Development & Scaffolding): ভাইগটস্কির ZPD হলো শিক্ষার্থীর বর্তমান সক্ষমতা এবং সম্ভাব্য সক্ষমতার মধ্যবর্তী একটি স্তর। একজন অধিক জ্ঞানী ব্যক্তির (More Knowledgeable Other – MKO) সহায়তায় (স্ক্যাফোল্ডিং) শিক্ষার্থী এই স্তরে পৌঁছাতে পারে।
পাঠ্যক্রমে নির্মাণবাদের প্রভাব:
- উদ্দেশ্য নির্ধারণ: উদ্দেশ্যগুলো পূর্বনির্ধারিত ও অনমনীয় থাকে না। বরং শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও অনুসন্ধানের উপর ভিত্তি করে উদ্দেশ্যগুলো বিকশিত হয়। সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তন, সহযোগিতা এবং স্ব-নির্দেশিত শিখনের (Self-directed learning) উপর জোর দেওয়া হয়।
- বিষয়বস্তু: বিষয়বস্তুকে একটি অখণ্ড ও আন্তঃসম্পর্কিত সমগ্র (integrated whole) হিসেবে দেখা হয়। পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও বিভিন্ন উৎস, যেমন—বাস্তব জগতের সমস্যা, মাল্টিমিডিয়া, এবং কমিউনিটিকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
- শিখন পদ্ধতি: পাঠ্যক্রমটি শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক হয়।
- প্রকল্প-ভিত্তিক শিখন (Project-Based Learning): শিক্ষার্থীরা কোনো একটি বাস্তব সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে এবং তার সমাধান খোঁজে।
- সমস্যা-ভিত্তিক শিখন (Problem-Based Learning): একটি জটিল ও বাস্তব সমস্যার মাধ্যমে পাঠ শুরু হয় এবং সেই সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা শিক্ষার্থীরা অর্জন করে।
- অনুসন্ধান-ভিত্তিক শিখন (Inquiry-Based Learning): শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তৈরি করে, তথ্য সংগ্রহ করে, এবং নিজেদের প্রশ্নের উত্তর নিজেরাই খুঁজে বের করে।
- সহযোগিতামূলক শিখন (Collaborative Learning): শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে একে অপরের সহায়তায় জ্ঞান নির্মাণ করে।
- মূল্যায়ন: প্রচলিত পরীক্ষার পরিবর্তে বাস্তবভিত্তিক বা অথেনটিক অ্যাসেসমেন্টের (Authentic Assessment) উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। যেমন—পোর্টফোলিও (Portfolio), প্রেজেন্টেশন, প্রকল্প, কেস স্টাডি, এবং পারফরম্যান্স-ভিত্তিক মূল্যায়ন। এখানে শিখন প্রক্রিয়ার মূল্যায়ন (Formative Assessment) ফলাফলের মূল্যায়নের (Summative Assessment) চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ঘ) মানবতাবাদ (Humanism) ও পাঠ্যক্রম:
মানবতাবাদী মনোবিজ্ঞান আচরণবাদ এবং মনোবিশ্লেষণের যান্ত্রিক ও হতাশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিকশিত হয়। আব্রাহাম মাসলো (Abraham Maslow) এবং কার্ল রজার্স (Carl Rogers) এই মতবাদের প্রধান প্রবক্তা। মানবতাবাদ ব্যক্তির স্বাধীনতা, মর্যাদা, অনন্যতা এবং আত্ম-উপলব্ধি বা আত্ম-প্রতিষ্ঠার (Self-actualization) উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করে। তাদের মতে, শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হলো একজন পরিপূর্ণ মানুষ তৈরি করা, যে নিজের সম্ভাবনাকে বিকশিত করতে সক্ষম হবে।
মানবতাবাদের মূল নীতি:
- সামগ্রিক ব্যক্তি (The Whole Person): শিক্ষাকে শুধুমাত্র শিক্ষার্থীর জ্ঞানীয় বিকাশে সীমাবদ্ধ না রেখে তার আবেগিক (affective), সামাজিক, শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক বিকাশের উপরও গুরুত্ব দিতে হবে।
- আত্ম-প্রতিষ্ঠার চাহিদা (Need for Self-Actualization): মাসলোর ‘চাহিদার সোপানতন্ত্র’ (Hierarchy of Needs) অনুযায়ী, মানুষের সর্বোচ্চ চাহিদা হলো আত্ম-প্রতিষ্ঠা। শিক্ষাব্যবস্থার উচিত শিক্ষার্থীদের এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়তা করা।
- শিক্ষার্থীর অনুভূতি ও আবেগ (Feelings and Emotions): শিখন প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীর অনুভূতি, আবেগ এবং আত্ম-মর্যাদাবোধ (Self-esteem) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি ইতিবাচক এবং সহায়ক পরিবেশ শিখনকে ত্বরান্বিত করে।
- শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক শিখন (Student-Centered Learning): কার্ল রজার্সের মতে, শিক্ষকের ভূমিকা হবে একজন সহায়ক বা ফ্যাসিলিটেটরের, যিনি শিক্ষার্থীর স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের জন্য একটি নিরাপদ ও আস্থাশীল পরিবেশ তৈরি করবেন।
পাঠ্যক্রমে মানবতাবাদের প্রভাব:
- উদ্দেশ্য নির্ধারণ: জ্ঞানীয় উদ্দেশ্যের পাশাপাশি আবেগিক (Affective Domain) উদ্দেশ্য, যেমন—মূল্যবোধ গঠন, ইতিবাচক মনোভাব তৈরি, সহানুভূতি এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর উপর জোর দেওয়া হয়।
- বিষয়বস্তু নির্বাচন: বিষয়বস্তু এমনভাবে নির্বাচন করা হয় যা শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত জীবন, আগ্রহ এবং অভিজ্ঞতার সাথে প্রাসঙ্গিক। শিক্ষার্থীদের পছন্দের সুযোগ দেওয়া হয় যে তারা কী পড়তে চায় এবং কীভাবে পড়তে চায়।
- শিখন পরিবেশ ও পদ্ধতি: পাঠ্যক্রম একটি নিরাপদ, সহায়ক, এবং ভীতিমুক্ত শিখন পরিবেশ তৈরির উপর গুরুত্ব দেয়। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হন এবং তাদের ব্যক্তিগত মতামতকে সম্মান করেন। এখানে মুক্ত আলোচনা, সমবায় শিখন (Cooperative Learning), এবং সৃজনশীল কাজের সুযোগ থাকে।
- মূল্যায়ন: গ্রেড বা নম্বরের চেয়ে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত অগ্রগতির উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। স্ব-মূল্যায়ন (Self-evaluation) এবং সহপাঠী কর্তৃক মূল্যায়নকে (Peer-evaluation) উৎসাহিত করা হয়। মূল্যায়ন প্রতিযোগিতামূলক না হয়ে সহযোগিতামূলক হয়।
২. বিকাশমূলক মনোবিজ্ঞান (Developmental Psychology) এবং পাঠ্যক্রম:
বিকাশমূলক মনোবিজ্ঞান মানুষের জীবনব্যাপী শারীরিক, জ্ঞানীয়, সামাজিক এবং আবেগিক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করে। পাঠ্যক্রম প্রণয়নের ক্ষেত্রে এটি একটি অপরিহার্য ভিত্তি, কারণ এটি আমাদের বলে দেয় যে কোন বয়সে শিশুরা কী শিখতে সক্ষম এবং তাদের বিকাশের স্তর অনুযায়ী শিখন অভিজ্ঞতা কেমন হওয়া উচিত। জ্যাঁ পিয়াজে, লেভ ভাইগটস্কি, এবং এরিক এরিকসনের তত্ত্বগুলো এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ক) জ্যাঁ পিয়াজের জ্ঞানীয় বিকাশের তত্ত্ব (Piaget’s Theory of Cognitive Development):
পিয়াজে দেখিয়েছেন যে, শিশুরা পর্যায়ক্রমে জ্ঞানীয় বিকাশের চারটি স্তরের মধ্যে দিয়ে যায়। প্রতিটি স্তরে তাদের চিন্তাভাবনার ধরণ আলাদা। পাঠ্যক্রম অবশ্যই এই স্তরগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
- সংবেদন-সঞ্চালনমূলক স্তর (Sensorimotor Stage, জন্ম – ২ বছর): এই স্তরে শিশুরা তাদের ইন্দ্রিয় এবং শারীরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে জগৎকে বোঝে। এই স্তরের পাঠ্যক্রম স্পর্শ, স্বাদ, গন্ধ, এবং ধ্বনি নির্ভর বাস্তব উপকরণের মাধ্যমে শিখনকে উৎসাহিত করবে।
- প্রাক-কার্যকরী স্তর (Preoperational Stage, ২ – ৭ বছর): শিশুরা ভাষা ও প্রতীক ব্যবহার করতে শেখে, কিন্তু তাদের চিন্তা আত্মকেন্দ্রিক এবং যুক্তিহীন হয়। এই স্তরের পাঠ্যক্রম খেলাধুলা, অভিনয়, এবং মূর্ত উপকরণের ব্যবহারের উপর জোর দেবে। বিমূর্ত ধারণা এড়িয়ে চলা হয়।
- মূর্ত কার্যকরী স্তর (Concrete Operational Stage, ৭ – ১১ বছর): এই স্তরে শিশুরা যৌক্তিক চিন্তা করতে পারে, কিন্তু তা শুধুমাত্র মূর্ত বা বাস্তব বস্তুর ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে। এই স্তরের পাঠ্যক্রম গণিতের জন্য বাস্তব উপকরণ (যেমন—কাঠি, ব্লক), বিজ্ঞানের জন্য হাতে-কলমে পরীক্ষা, এবং শ্রেণিকরণের মতো কাজের সুযোগ করে দেবে।
- যৌক্তিক কার্যকরী স্তর (Formal Operational Stage, ১১ বছর ও ঊর্ধ্বে): কিশোর-কিশোরীরা বিমূর্ত ধারণা, অনুমান এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চিন্তা করতে সক্ষম হয়। এই স্তরের পাঠ্যক্রম উচ্চতর গণিত, দর্শন, এবং জটিল সমস্যা সমাধানের সুযোগ প্রদান করবে।
খ) লেভ ভাইগটস্কির সামাজিক-সাংস্কৃতিক তত্ত্ব (Vygotsky’s Socio-Cultural Theory):
ভাইগটস্কি সামাজিক মিথস্ক্রিয়াকে জ্ঞানীয় বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখেছেন। তাঁর ZPD (Zone of Proximal Development) ধারণাটি পাঠ্যক্রমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাঠ্যক্রম এমনভাবে ডিজাইন করতে হবে যা শিক্ষার্থীর বর্তমান পারদর্শিতার স্তরের চেয়ে একটু এগিয়ে থাকে, কিন্তু তার নাগালের বাইরে নয়। শিক্ষক বা সক্ষম সহপাঠীর সহায়তায় (Scaffolding) শিক্ষার্থী এই নতুন জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জন করতে পারে। পাঠ্যক্রমে সহযোগিতামূলক প্রকল্প, গ্রুপ ডিসকাশন এবং পিয়ার টিউটরিং-এর মতো কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে ভাইগটস্কির তত্ত্বকে কাজে লাগানো হয়।
গ) এরিক এরিকসনের মনঃসামাজিক বিকাশের তত্ত্ব (Erikson’s Theory of Psychosocial Development):
এরিকসন দেখিয়েছেন যে, মানুষ জীবনব্যাপী আটটি মনঃসামাজিক সংকটের (Psychosocial Crises) সম্মুখীন হয়। বিদ্যালয় জীবনের সাথে সম্পর্কিত স্তরগুলো পাঠ্যক্রমকে প্রভাবিত করে:
- উদ্যোগ বনাম অপরাধবোধ (Initiative vs. Guilt, ৩-৬ বছর): পাঠ্যক্রম শিশুদের প্রশ্ন করতে, অন্বেষণ করতে এবং খেলার মাধ্যমে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উৎসাহিত করবে।
- শ্রমোদ্যম বনাম হীনমন্যতা (Industry vs. Inferiority, ৬-১২ বছর): এই স্তরে শিশুরা সামাজিক ও জ্ঞানীয় দক্ষতা অর্জনে আগ্রহী হয়। পাঠ্যক্রম তাদের সফলভাবে কাজ শেষ করার সুযোগ করে দেবে এবং তাদের কৃতিত্বের জন্য প্রশংসা করবে, যাতে তাদের মধ্যে হীনমন্যতা তৈরি না হয়।
- পরিচয় বনাম পরিচয় সংকট (Identity vs. Role Confusion, ১২-১৮ বছর): কিশোর বয়সে শিক্ষার্থীরা ‘আমি কে?’ এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। পাঠ্যক্রম তাদের বিভিন্ন ভূমিকা অন্বেষণ করতে, নিজস্ব মতামত প্রকাশ করতে, এবং ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবার সুযোগ দেবে।
৩. পাঠ্যক্রমের বিভিন্ন উপাদানে মনোবিজ্ঞানের প্রয়োগ:
পাঠ্যক্রমের চারটি প্রধান উপাদান—উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু, শিখন পদ্ধতি এবং মূল্যায়ন—প্রতিটিতেই মনোবিজ্ঞানের গভীর ছাপ রয়েছে।
- উদ্দেশ্য নির্ধারণ (Formulating Objectives): আচরণবাদ আমাদের শেখায় উদ্দেশ্যগুলোকে সুনির্দিষ্ট ও পরিমাপযোগ্য করতে। জ্ঞানমূলক মতবাদ শেখায় বোধগম্যতা ও সমস্যা সমাধানের মতো উচ্চতর মানসিক দক্ষতার উপর জোর দিতে। মানবতাবাদ শেখায় আবেগিক এবং সামাজিক বিকাশের উদ্দেশ্য অন্তর্ভুক্ত করতে। একটি ভারসাম্যপূর্ণ পাঠ্যক্রম এই তিন ধরনের উদ্দেশ্যকেই (জ্ঞানীয়, আবেগিক, মনোসঞ্চালনমূলক) গুরুত্ব দেয়।
- বিষয়বস্তু নির্বাচন (Selecting Content): পিয়াজের তত্ত্ব অনুযায়ী, বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীর বয়স ও জ্ঞানীয় বিকাশের স্তরের উপযোগী হতে হবে। ব্রুনারের সর্পিল পাঠ্যক্রমের ধারণা বিষয়বস্তুর পুনরাবৃত্তি ও গভীরতা বাড়াতে সাহায্য করে। মানবতাবাদ বলে, বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীর জীবন ও আগ্রহের সাথে প্রাসঙ্গিক হতে হবে।
- শিখন অভিজ্ঞতা ও পদ্ধতির সংগঠন (Organizing Learning Experiences): মনোবিজ্ঞান আমাদের বিভিন্ন শিখন পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দেয়। আচরণবাদ থেকে আমরা ড্রিল ও অনুশীলন পাই, জ্ঞানমূলক মতবাদ থেকে পাই সমস্যা-সমাধান ও আবিষ্কারমূলক শিখন, নির্মাণবাদ থেকে পাই প্রকল্প-ভিত্তিক ও সহযোগিতামূলক শিখন, এবং মানবতাবাদ থেকে পাই শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক ও মুক্ত আলোচনার পদ্ধতি। একজন দক্ষ পাঠ্যক্রম পরিকল্পনাকারী বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্যের প্রকৃতি অনুযায়ী সঠিক পদ্ধতি নির্বাচন করেন।
- মূল্যায়ন (Evaluation): মনোবিজ্ঞান আমাদের শিখিয়েছে যে মূল্যায়ন শুধুমাত্র শিখন শেষে হয় না, এটি একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। আচরণবাদ নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষার জন্ম দিয়েছে। নির্মাণবাদ আমাদের অথেনটিক অ্যাসেসমেন্ট, যেমন—পোর্টফোলিও এবং পারফরম্যান্স-ভিত্তিক মূল্যায়নের দিকে নিয়ে গেছে। মানবতাবাদ স্ব-মূল্যায়নের গুরুত্ব বুঝিয়েছে। আধুনিক পাঠ্যক্রম ফরমেটিভ এবং সামেটিভ উভয় ধরনের মূল্যায়নের সমন্বয় করে শিক্ষার্থীর সার্বিক চিত্র তুলে ধরে।