Concept and Aims of Education (শিক্ষার ধারণা ও লক্ষ্য)
ভূমিকা:
শিক্ষা মানবজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি কেবল অক্ষরজ্ঞান বা তথ্য আহরণের প্রক্রিয়া নয়, বরং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার বিকাশ, চরিত্র গঠন এবং সামাজিক জীব হিসেবে তাকে যোগ্য করে তোলার এক নিরন্তর প্রয়াস। শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ তার পারিপার্শ্বিক জগৎ সম্পর্কে সচেতন হয়, সমস্যা সমাধানে সক্ষম হয় এবং উন্নততর জীবনের দিকে অগ্রসর হয়। যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষার ধারণা ও লক্ষ্যেরও পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু তার মৌলিক উদ্দেশ্য – মানুষকে পরিপূর্ণ ও বিকশিত করা – তা আজও অপরিবর্তিত।
শিক্ষার ধারণা (Concept of Education):
শিক্ষার ধারণাটি বহুমাত্রিক ও ব্যাপক। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
- ব্যুৎপত্তিগত অর্থ (Etymological Meaning):
“শিক্ষা” শব্দটি প্রধানত তিনটি ল্যাটিন শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে মনে করা হয়:
১. Educare (এডুকিয়ার): এর অর্থ হলো প্রতিপালন করা (to bring up), পরিচর্যা করা বা पोषण করা (to nourish)। এই অর্থে শিক্ষা হলো শিশুকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিকশিত হতে সাহায্য করা।
২. Educere (এডুকেরি): এর অর্থ হলো ভেতরের সম্ভাবনাকে বের করে আনা বা বিকশিত করা (to lead out or to draw out)। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, শিক্ষা শিশুর মধ্যে সুপ্ত থাকা গুণাবলী ও সম্ভাবনাগুলিকে প্রকাশ করতে সহায়তা করে। ‘E’ অর্থ ‘বাহির’ এবং ‘Ducere’ অর্থ ‘পরিচালনা করা’।
৩. Educatum (এডুকেটাম): এর অর্থ হলো শিক্ষাদানের কাজ বা প্রশিক্ষণ (act of teaching or training)। এটি শিক্ষার পদ্ধতিগত ও প্রায়োগিক দিকটিকে নির্দেশ করে।
এই ব্যুৎপত্তিগত অর্থগুলি থেকে বোঝা যায় যে, শিক্ষা হলো জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জনের পাশাপাশি দক্ষতা, সঠিক অভ্যাস এবং কাঙ্ক্ষিত দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটানোর একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া। এটি শিশুর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে লালন করে এবং তাকে পারিপার্শ্বিক জগতের সাথে অভিযোজিত হতে সাহায্য করে।
- বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও দার্শনিকের সংজ্ঞা (Definitions by Various Educators and Philosophers):
শিক্ষার স্বরূপ উপলব্ধি করার জন্য বিভিন্ন সময়ের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ও দার্শনিকদের দেওয়া সংজ্ঞাগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।- প্লেটো (Plato): গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর মতে, “শিক্ষা হলো দেহ ও আত্মার মধ্যে সেই সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতার বিকাশ, যা সে অর্জন করতে সক্ষম।” তিনি শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির আদর্শ রূপ প্রকাশের উপর জোর দিয়েছিলেন।
- অ্যারিস্টটল (Aristotle): প্লেটোর ছাত্র অ্যারিস্টটলের মতে, “সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই শিক্ষা। শিক্ষা মানুষের মানসিক ক্ষমতার (faculty) বিকাশ ঘটায়, বিশেষত তার মনের, যাতে সে পরম সত্য, শিব (goodness) ও সুন্দরের (beauty) উপলব্ধি বা ধ্যান করতে পারে।” তিনি শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির যৌক্তিক চিন্তার বিকাশে গুরুত্ব দিতেন।
- পেস্তালৎসি (Pestalozzi): সুইস শিক্ষাবিদ পেস্তালৎসির মতে, “শিক্ষা হলো মানুষের অন্তর্নিহিত ক্ষমতাগুলির স্বাভাবিক, সুসংহত ও প্রগতিশীল বিকাশ।” তিনি শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের উপর গুরুত্ব আরোপ করতেন।
- ফ্রোয়েবেল (Froebel): কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতির প্রবর্তক, জার্মান শিক্ষাবিদ ফ্রোয়েবেলের মতে, “শিক্ষা হলো সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শিশু তার ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে প্রকাশ করে (makes internal external)।” তিনি মনে করতেন, বীজ যেমন বৃক্ষের সম্ভাবনা বহন করে, তেমনি শিশুর মধ্যেও পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার সম্ভাবনা নিহিত থাকে, শিক্ষা সেই সম্ভাবনাকে বিকশিত করে।
- জন ডিউই (John Dewey): আমেরিকান দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ জন ডিউই-এর মতে, “শিক্ষা হলো অভিজ্ঞতার নিরন্তর পুনর্গঠনের মাধ্যমে জীবনযাপনের প্রক্রিয়া (Education is the process of reconstruction of experiences)।” তিনি আরও বলেছেন, “শিক্ষা জীবনের জন্য প্রস্তুতি নয়, শিক্ষাই জীবন (Education is not a preparation for life; education is life itself)।” ডিউই শিক্ষাকে একটি সামাজিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেছেন।
- টি.পি. নান (T.P. Nunn): ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ টি.পি. নানের মতে, “শিক্ষা শিশুর ব্যক্তিত্বের এমন পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটায় যাতে সে তার সামর্থ্য অনুযায়ী মানবজীবনে মৌলিক অবদান রাখতে পারে।” তিনি ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের উপর জোর দিয়েছিলেন।
- রেডেন (Redden): রেডেনের মতে, “শিক্ষা হলো পরিপক্ক ব্যক্তির দ্বারা অপরিপক্ক ব্যক্তির উপর সুচিন্তিত ও পদ্ধতিগত প্রভাব; যার মাধ্যমে নির্দেশনা, শৃঙ্খলা এবং শারীরিক, বৌদ্ধিক, নান্দনিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতার সুসংহত বিকাশ ঘটে, যা ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রয়োজন অনুযায়ী এবং চূড়ান্তভাবে স্রষ্টার সাথে শিক্ষার্থীর মিলনের দিকে পরিচালিত হয়।”
- স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda): ভারতীয় নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা স্বামী বিবেকানন্দের মতে, “মানুষের অন্তর্নিহিত পরিপূর্ণতার প্রকাশই হলো শিক্ষা (Education is the manifestation of the perfection already in man)।” তিনি মনে করতেন, জ্ঞান বাইরে থেকে আসে না, তা মানুষের মধ্যেই থাকে, শিক্ষা কেবল সেই আবরণ উন্মোচন করে।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore): বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, “শিক্ষা মানে হলো মনকে সেই চরম সত্য খুঁজে পেতে সক্ষম করা, যা আমাদের জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্তি দেয় এবং আমাদের ভেতরের আলো (inner light) দান করে, ক্ষমতা নয়, বরং ভালোবাসতে শেখায়।” তিনি প্রকৃতির সান্নিধ্যে আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষার কথা বলেছেন।
- মহাত্মা গান্ধী (Mahatma Gandhi): ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর মতে, “শিক্ষা বলতে আমি বুঝি শিশুর দেহ, মন ও আত্মার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ।” তিনি হাতের কাজের মাধ্যমে উৎপাদনমুখী শিক্ষার (বুনিয়াদি শিক্ষা) উপর জোর দিয়েছিলেন।
- ডঃ জাকির হোসেন (Dr. Zakir Hussain): বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডঃ জাকির হোসেনের মতে, “শিক্ষা হলো ব্যক্তির মনের পূর্ণ সম্ভাবনার বিকাশ।”
- ভারতীয় শিক্ষা কমিশন (১৯৬৪-৬৬) বা কোঠারি কমিশন: এই কমিশনের মতে, “শিক্ষা মানুষের জীবন, চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার সাথে সম্পর্কিত হওয়া উচিত, যাতে তা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।” এই কমিশন শিক্ষার জাতীয় লক্ষ্যের উপর গুরুত্ব দিয়েছে।
এই সংজ্ঞাগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শিক্ষা শুধুমাত্র জ্ঞানার্জন নয়, বরং এটি ব্যক্তির সামগ্রিক বিকাশ, সামাজিক অভিযোজন এবং জীবনের জন্য প্রস্তুতি।
- শিক্ষার মৌলিক বৈশিষ্ট্য (Basic Characteristics of Education):
উপরিউক্ত সংজ্ঞা ও আলোচনা থেকে শিক্ষার কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা যায়:
১. জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া (Lifelong process): শিক্ষা নির্দিষ্ট বয়স বা পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়, এটি মাতৃক্রোড় থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত চলতে থাকে।
২. গতিশীল প্রক্রিয়া (Dynamic process): সমাজের পরিবর্তন ও চাহিদার সাথে সাথে শিক্ষার ধারণা, পদ্ধতি ও লক্ষ্যেরও পরিবর্তন ঘটে।
৩. অন্তর্নিহিত ক্ষমতার বিকাশ (Development of inner potentialities): শিক্ষা ব্যক্তির মধ্যে সুপ্ত থাকা সম্ভাবনা ও গুণাবলীকে বিকশিত করতে সাহায্য করে।
৪. অভিযোজনমূলক প্রক্রিয়া (Process of adjustment): শিক্ষা ব্যক্তিকে পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে সার্থকভাবে অভিযোজিত হতে শেখায়।
৫. বিকাশমূলক প্রক্রিয়া (Developmental process): শিক্ষা ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক ইত্যাদি সকল দিকের সুষম বিকাশে সহায়তা করে।
৬. সচেতন ও উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রক্রিয়া (Conscious and purposeful process): শিক্ষা সাধারণত সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত হয়।
৭. দ্বিমুখী ও ত্রিমুখী প্রক্রিয়া (Bipolar and Tripolar process): অ্যাডামসের মতে, শিক্ষা একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া (শিক্ষক ও শিক্ষার্থী)। জন ডিউই-এর মতে, এটি একটি ত্রিমুখী প্রক্রিয়া (শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং সমাজ বা পাঠ্যক্রম)।
৮. সামাজিক প্রক্রিয়া (Social process): শিক্ষা সমাজেই সংঘটিত হয় এবং এটি সামাজিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সংরক্ষণ ও সঞ্চারণে সহায়তা করে।
৯. মূল্যবোধ গঠন (Value inculcation): শিক্ষা ব্যক্তির মধ্যে ইতিবাচক মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও আদর্শ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১০. এটি কেবল তথ্য আহরণ নয় (Not mere information gathering): শিক্ষা মানে শুধু তথ্য বা জ্ঞান সংগ্রহ করা নয়, বরং সেই জ্ঞানকে অনুধাবন করা এবং জীবনে প্রয়োগ করতে শেখা। - শিক্ষার প্রকারভেদ (Types of Education):
শিক্ষাদানের পদ্ধতি, প্রতিষ্ঠান এবং উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে শিক্ষাকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়:
১. প্রথাগত শিক্ষা (Formal Education): এই ধরনের শিক্ষা সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন, সময়সীমা, পাঠ্যক্রম এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (যেমন – বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়) মাধ্যমে প্রদান করা হয়। এটি সচেতন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আচরণ পরিবর্তনের জন্য পরিকল্পিত। এর শেষে সাধারণত ডিগ্রি বা শংসাপত্র প্রদান করা হয়। এটি মূলত শিক্ষক-কেন্দ্রিক এবং কঠোর শৃঙ্খলার অধীনে পরিচালিত হয়।
২. অপ্রথাগত শিক্ষা (Informal Education): এই শিক্ষা কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা পূর্বপরিকল্পিত ব্যবস্থার মাধ্যমে দেওয়া হয় না। ব্যক্তি তার জীবনযাপনের পথে পরিবার, প্রতিবেশী, খেলার সাথী, সমাজ, গণমাধ্যম (যেমন – টেলিভিশন, সংবাদপত্র), বাজার, ধর্মীয় স্থান ইত্যাদি থেকে প্রতিনিয়ত এই শিক্ষা লাভ করে। এটি সাধারণত আকস্মিক, স্বতঃস্ফূর্ত এবং ব্যক্তির নিজস্ব প্রয়োজন ও আগ্রহ দ্বারা পরিচালিত হয়। এর কোনো নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম, সময়সীমা বা শংসাপত্র থাকে না। এটি “মাতৃক্রোড় থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত” বিস্তৃত।
৩. প্রথাবহির্ভূত শিক্ষা (Non-formal Education): এটি প্রথাগত ও অপ্রথাগত শিক্ষার মাঝামাঝি একটি নমনীয় ব্যবস্থা। এটি প্রথাগত শিক্ষার মতো কাঠামোগত হলেও ততটা কঠোর নয়, আবার অপ্রথাগত শিক্ষার মতো সম্পূর্ণ বাঁধনহীনও নয়। যেমন – পত্রালাপ কোর্স (Correspondence course), সান্ধ্যকালীন ক্লাস, বয়স্ক শিক্ষা, দূরশিক্ষা (Distance education), মুক্ত বিদ্যালয় (Open school) ও মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (Open university) ইত্যাদি এই ধরনের শিক্ষার উদাহরণ। এর নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পাঠ্যক্রম থাকতে পারে, তবে এটি শিক্ষার্থীদের সুবিধা অনুযায়ী পরিচালিত হয়। - শিক্ষার মাত্রা/অর্থ (Dimensions/Meaning of Education):
শিক্ষাকে তার পরিধি ও উদ্দেশ্যের নিরিখে দুটি প্রধান অর্থে ব্যাখ্যা করা হয়:
১. সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা (Narrow Meaning of Education): এই অর্থে শিক্ষা বলতে মূলত পুঁথিগত জ্ঞান অর্জন, তথ্য সংগ্রহ এবং বিদ্যালয় বা মহাবিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম অনুযায়ী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ডিগ্রি লাভ করাকে বোঝায়। এটি মূলত তথ্যের সঞ্চয়ন এবং শিশুর মস্তিষ্কে জ্ঞান প্রবেশ করানোর প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হয়। এর পরিধি সীমাবদ্ধ এবং এটি জীবনের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলে।
২. ব্যাপক অর্থে শিক্ষা (Broader Meaning of Education): এই অর্থে শিক্ষা হলো একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া, যা ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ বিকাশে সহায়তা করে। এটি কেবল জ্ঞানার্জন নয়, বরং ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক, নান্দনিক ও বৃত্তিমূলক – সকল দিকের সুষম বিকাশ ঘটায়। এই শিক্ষা ব্যক্তিকে পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে সার্থকভাবে অভিযোজিত হতে, সমস্যা সমাধানে এবং উন্নততর জীবনযাপনে সক্ষম করে তোলে। এই অর্থে, “জীবনই শিক্ষা এবং শিক্ষাই জীবন।” বিদ্যালয়ের ভেতরের ও বাইরের সকল অভিজ্ঞতাই এই শিক্ষার অন্তর্গত।
শিক্ষার লক্ষ্য (Aims of Education):
শিক্ষা একটি উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রক্রিয়া। তাই এর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকা অপরিহার্য। শিক্ষার লক্ষ্য ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে। শিক্ষার প্রধান লক্ষ্যগুলিকে নিম্নলিখিতভাবে আলোচনা করা যেতে পারে:
১. জ্ঞানার্জন বা তথ্য সংগ্রহ (Acquisition of Knowledge): শিক্ষার একটি প্রাথমিক লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান ও তথ্য সরবরাহ করা। এটি জগৎ ও জীবন সম্পর্কে জানার কৌতূহল মেটায় এবং উচ্চতর শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করে। তবে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শুধুমাত্র জ্ঞানার্জনকে শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে দেখা হয় না।
২. শারীরিক বিকাশ (Physical Development): “সুস্থ দেহে সুস্থ মন” – এই প্রবাদটি শিক্ষার শারীরিক লক্ষ্যের গুরুত্ব নির্দেশ করে। খেলাধুলা, শরীরচর্চা এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা শিক্ষার অঙ্গ, যা শিশুর শারীরিক সুস্থতা ও বিকাশে সহায়তা করে।
৩. মানসিক ও বৌদ্ধিক বিকাশ (Mental and Intellectual Development): শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীর মানসিক ক্ষমতার (যেমন – চিন্তাশক্তি, যুক্তিবোধ, বিচারক্ষমতা, সৃজনশীলতা, অনুসন্ধিৎসা) বিকাশ ঘটানো। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থী স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে এবং সমস্যা সমাধানে সক্ষম হয়।
৪. বৃত্তিমূলক লক্ষ্য বা জীবিকা অর্জনের প্রস্তুতি (Vocational Aim or Preparation for Livelihood): শিক্ষা ব্যক্তিকে কোনো বৃত্তি বা পেশার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করে, যাতে সে आत्मनिर्भर হতে পারে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। গান্ধীজির বুনিয়াদি শিক্ষায় এই লক্ষ্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
৫. চরিত্র গঠন ও নৈতিক বিকাশ (Character Building and Moral Development): শিক্ষা ব্যক্তির মধ্যে সততা, সহানুভূতি, শৃঙ্খলা, কর্তব্যপরায়ণতা, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটায়। একটি সুস্থ সমাজ গঠনে চরিত্রবান নাগরিক অপরিহার্য। স্বামী বিবেকানন্দ শিক্ষার এই লক্ষ্যের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
৬. সামাজিক বিকাশ ও অভিযোজন (Social Development and Adjustment): মানুষ সামাজিক জীব। শিক্ষা ব্যক্তিকে সমাজের রীতিনীতি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন করে এবং তাকে সমাজের উপযুক্ত সদস্য হিসেবে গড়ে তোলে। সহযোগিতা, সহনশীলতা, নেতৃত্বদানের ক্ষমতা ইত্যাদি সামাজিক গুণাবলী বিকাশে শিক্ষা সহায়তা করে।
৭. সাংস্কৃতিক বিকাশ (Cultural Development): শিক্ষা সংস্কৃতির সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তার সঞ্চারণে সহায়তা করে। সাহিত্য, শিল্পকলা, সঙ্গীত, নৃত্য ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশ ঘটে।
৮. আত্মোপলব্ধি বা পরিপূর্ণতার বিকাশ (Self-realization or Development of Perfection): অনেক দার্শনিক, বিশেষত ভাববাদী দার্শনিকরা এবং স্বামী বিবেকানন্দ, শিক্ষার চরম লক্ষ্য হিসেবে আত্মোপলব্ধি বা ব্যক্তির অন্তর্নিহিত পরিপূর্ণতার বিকাশকে দেখেছেন। এর অর্থ হলো নিজের স্বরূপকে জানা এবং জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য উপলব্ধি করা।
৯. আধ্যাত্মিক বিকাশ (Spiritual Development): ভাববাদী দর্শন অনুযায়ী, জড় জগতের ঊর্ধ্বে এক আধ্যাত্মিক সত্তার অস্তিত্ব রয়েছে। শিক্ষা ব্যক্তিকে সেই আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে এবং পরম সত্তার সাথে একাত্মতা অনুভব করতে সাহায্য করে।
১০. অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন (Reconstruction of Experiences): জন ডিউই-এর মতে, শিক্ষা হলো অভিজ্ঞতার নিরন্তর পুনর্গঠন। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন এবং পুরাতন অভিজ্ঞতাকে নতুন আলোকে বিচার করাই শিক্ষার লক্ষ্য।
১১. প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিকাশ (Development in Harmony with Nature): প্রকৃতিবাদী দার্শনিক যেমন রুশো এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতির সান্নিধ্যে শিশুর স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের উপর জোর দিয়েছেন। তাঁদের মতে, কৃত্রিম পরিবেশের পরিবর্তে প্রকৃতির কোলে বাধাহীনভাবে বেড়ে ওঠাই শিশুর জন্য শ্রেয়।
১২. গণতান্ত্রিক নাগরিক তৈরি (Creation of Democratic Citizens): আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো নাগরিকদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা, অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতা এবং জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তোলা।
১৩. অবসর যাপনের জন্য শিক্ষা (Education for Leisure): আধুনিক জীবনে অবসরের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায়, শিক্ষাকে এমনভাবে পরিকল্পিত করা উচিত যাতে ব্যক্তি তার অবসর সময়কে সৃজনশীল ও গঠনমূলক কাজে ব্যবহার করতে পারে।
১৪. জাতীয় সংহতি ও আন্তর্জাতিক বোঝাপড়া (National Integration and International Understanding): শিক্ষা সংকীর্ণ প্রাদেশিকতা, জাতিভেদ, ধর্মীয় গোঁড়ামি ইত্যাদি দূর করে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি গড়ে তুলতে সাহায্য করে। পাশাপাশি, বিশ্বশান্তি ও সহযোগিতার জন্য আন্তর্জাতিক বোঝাপড়ার মনোভাব তৈরি করাও শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য।
১৫. মূল্যবোধের বিকাশ (Development of Values): শিক্ষা ব্যক্তির মধ্যে নৈতিক, সামাজিক, নান্দনিক, আধ্যাত্মিক, গণতান্ত্রিক ইত্যাদি ইতিবাচক মূল্যবোধের উন্মেষ ঘটায়, যা তাকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। ভারতীয় সংবিধানে উল্লিখিত মূল্যবোধগুলি (যেমন – ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব) শিক্ষায় প্রতিফলিত হওয়া উচিত।
শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণে জীবনের দর্শনের ভূমিকা:
শিক্ষার লক্ষ্য স্থিরীকরণে ব্যক্তি বা সমাজের জীবনদর্শন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন, ভাববাদী দর্শন আত্মোপলব্ধি ও আধ্যাত্মিক বিকাশের উপর জোর দেয়, প্রকৃতিবাদী দর্শন প্রকৃতির অনুসরণ ও শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের কথা বলে, প্রয়োগবাদী দর্শন সামাজিক উপযোগিতা ও অভিজ্ঞতার পুনর্গঠনকে গুরুত্ব দেয়, এবং মার্কসবাদী দর্শন শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের লক্ষ্য রাখে। তাই, শিক্ষার লক্ষ্য কোনো স্থির বিষয় নয়, এটি দর্শন ও সামাজিক চাহিদার নিরিখে পরিবর্তনশীল।
উপসংহার:
শিক্ষার ধারণা ও লক্ষ্য অত্যন্ত ব্যাপক ও পরিবর্তনশীল। এটি কেবল জ্ঞান বিতরণের যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি একটি জীবনব্যাপী সাধনা যা ব্যক্তিকে তার সম্পূর্ণ সম্ভাবনায় বিকশিত হতে এবং সমাজ ও মানবতার কল্যাণে অবদান রাখতে উদ্বুদ্ধ করে। শিক্ষার সঠিক ধারণা ও লক্ষ্যের উপলব্ধি একটি সুস্থ, প্রগতিশীল ও মানবিক সমাজ গঠনের জন্য অপরিহার্য।
One Comment