Philosophical Bases of Curriculum [পাঠ্যক্রমের দার্শনিক ভিত্তি] notes and practice set

ভূমিকা: শিক্ষার পথনির্দেশক দর্শন

শিক্ষা একটি উদ্দেশ্যমুখী, জীবনব্যাপী এবং পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে ব্যক্তি তার অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার বিকাশ ঘটায় এবং সমাজের একজন সক্রিয় ও দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এই মহৎ উদ্দেশ্যকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য যে সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত পথনির্দেশিকা বা নীলনকশা অনুসরণ করা হয়, তাই হলো পাঠ্যক্রম (Curriculum)। প্রচলিত অর্থে পাঠ্যক্রমকে কেবল কয়েকটি পাঠ্যবিষয় ও তার তালিকার সমষ্টি হিসেবে ভাবা হলেও, আধুনিক শিক্ষাচিন্তায় এর পরিধি অনেক ব্যাপক। পাঠ্যক্রম হলো বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ও বাইরে শিক্ষার্থীর অর্জিত সমস্ত অভিজ্ঞতা, যা তার জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং মূল্যবোধকে প্রভাবিত করে। এটি শিক্ষার ‘কী’ (What) এবং ‘কীভাবে’ (How) এই প্রশ্নগুলির উত্তর দেয়।

কিন্তু শিক্ষার সবচেয়ে মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো—‘কেন?’ (Why)। আমরা কেন শিক্ষা দিই? শিক্ষার চূড়ান্ত লক্ষ্য কী? কোন জ্ঞান সবচেয়ে মূল্যবান? সমাজের প্রতি শিক্ষার দায়িত্ব কী? এই ‘কেন’ প্রশ্নগুলির উত্তর প্রদানের দায়িত্ব দর্শনের। দর্শন (Philosophy), যার আক্ষরিক অর্থ ‘জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ’, হলো জীবন, জগৎ, বাস্তবতা, জ্ঞান, সত্য এবং মূল্যবোধ সম্পর্কিত মৌলিক প্রশ্নগুলির যৌক্তিক অনুসন্ধান। শিক্ষাবিদ জন ডিউই-এর ভাষায়, “দর্শন হলো শিক্ষার সাধারণ তত্ত্ব এবং শিক্ষা হলো দর্শনের পরীক্ষাগার।” অর্থাৎ, দর্শন শিক্ষাকে তাত্ত্বিক ভিত্তি ও দিকনির্দেশনা প্রদান করে, আর শিক্ষা সেই দার্শনিক তত্ত্বগুলোকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে তার কার্যকারিতা যাচাই করে।

সুতরাং, পাঠ্যক্রম ও দর্শনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। একটি দার্শনিক ভিত্তি ছাড়া পাঠ্যক্রম একটি লক্ষ্যহীন, অসংলগ্ন এবং প্রাণহীন কাঠামোতে পরিণত হয়। দর্শন পাঠ্যক্রমকে তার আত্মা ও উদ্দেশ্য প্রদান করে। এই প্রবন্ধে আমরা পাঠ্যক্রমের দার্শনিক ভিত্তি বলতে কী বোঝায়, দর্শনের বিভিন্ন শাখা কীভাবে পাঠ্যক্রমকে প্রভাবিত করে, এবং প্রধান প্রধান দার্শনিক মতবাদগুলি কীভাবে পাঠ্যক্রমের রূপরেখা নির্মাণে ভূমিকা রেখেছে, তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।

দর্শন ও পাঠ্যক্রমের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক

দর্শন পাঠ্যক্রমের প্রতিটি উপাদানকে—লক্ষ্য, বিষয়বস্তু, শিক্ষণ পদ্ধতি, মূল্যায়ন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর ভূমিকা—গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এই সম্পর্ককে দর্শনের প্রধান তিনটি শাখার নিরিখে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়:

১. অধিবিদ্যা বা তত্ত্ববিদ্যা (Metaphysics): বাস্তবতার প্রকৃতি ও পাঠ্যক্রম
অধিবিদ্যা দর্শনের সেই শাখা যা বাস্তবতা বা অস্তিত্বের চূড়ান্ত প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করে। এর মূল প্রশ্নগুলি হলো: বাস্তবতা কী? এটি কি ভাবগত (spiritual) নাকি বস্তুগত (material)? জগৎ কি একক সত্তা দ্বারা নির্মিত নাকি বহু সত্তার সমন্বয়? মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য কী? ঈশ্বর, আত্মা এবং অমরত্বের কি কোনো অস্তিত্ব আছে?

  • পাঠ্যক্রমে প্রভাব: অধিবিদ্যা নির্ধারণ করে দেয় কোন জ্ঞানকে ‘বাস্তব’ এবং অপরিহার্য বলে গণ্য করা হবে।
    • ভাববাদী অধিবিদ্যা: যদি বিশ্বাস করা হয় যে চূড়ান্ত বাস্তবতা হলো মন, চেতনা বা আত্মা (ভাববাদ), তবে পাঠ্যক্রমে সেইসব বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হবে যা মনন ও আত্মার বিকাশে সহায়ক। যেমন: দর্শন, ধর্ম, নীতিশাস্ত্র, সাহিত্য, ইতিহাস এবং শিল্পকলা। এই বিষয়গুলি শাশ্বত সত্য ও আদর্শের সন্ধান দেয়।
    • বাস্তববাদী অধিবিদ্যা: যদি বিশ্বাস করা হয় যে বাস্তবতা হলো আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, বস্তুগত জগৎ যা আমাদের মনের উপর নির্ভরশীল নয় (বাস্তববাদ), তবে পাঠ্যক্রমে গুরুত্ব পাবে বিজ্ঞান, গণিত এবং পর্যবেক্ষণযোগ্য জগৎ সম্পর্কিত বিষয়গুলি। এখানে লক্ষ্য হবে প্রকৃতির নিয়মাবলীকে বোঝা।
    • সুতরাং, একটি সমাজ বাস্তবতাকে কীভাবে দেখে, তার প্রতিফলন ঘটে সেই সমাজের পাঠ্যক্রমে।

২. জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology): জ্ঞানের উৎস ও শিক্ষণ পদ্ধতি
জ্ঞানতত্ত্ব জ্ঞানের প্রকৃতি, উৎস, বৈধতা এবং সীমা নিয়ে আলোচনা করে। এর প্রশ্নগুলি হলো: জ্ঞান কী? আমরা কীভাবে জ্ঞান অর্জন করি? জ্ঞানের উৎস কী—ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা (empiricism), যুক্তি (rationalism), স্বজ্ঞা (intuition), নাকি আপ্তবাক্য (authority)? সত্যতা কীভাবে যাচাই করা হয়?

  • পাঠ্যক্রমে প্রভাব: জ্ঞানতত্ত্ব পাঠ্যক্রমের শিক্ষণ পদ্ধতি এবং জ্ঞান সঞ্চালনের প্রক্রিয়াকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে।
    • যদি মনে করা হয় জ্ঞান বাইরে থেকে অর্জিত হয় এবং শিক্ষক বা গ্রন্থই হলো তার উৎস (বাস্তববাদ), তবে শিক্ষণ পদ্ধতি হবে বক্তৃতা-নির্ভর, স্মৃতি-নির্ভর এবং পাঠ্যপুস্তক-কেন্দ্রিক। শিক্ষার্থী হবে জ্ঞানের নিষ্ক্রিয় গ্রহীতা।
    • যদি মনে করা হয় যে জ্ঞান অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নির্মিত হয় (প্রয়োগবাদ), তবে শিক্ষণ পদ্ধতি হবে সক্রিয়, প্রকল্প-ভিত্তিক এবং সমস্যা-সমাধানমূলক। শিক্ষার্থী হবে জ্ঞানের সক্রিয় নির্মাতা।
    • যদি মনে করা হয় যে জ্ঞান যুক্তির মাধ্যমে লাভ করা যায় (যুক্তিবাদ), তবে শিক্ষণ পদ্ধতিতে বিতর্ক, আলোচনা এবং যৌক্তিক বিশ্লেষণের উপর জোর দেওয়া হবে।
    • এইভাবে, জ্ঞান সম্পর্কিত ধারণা শিক্ষকের শিক্ষাদানের কৌশল এবং শিক্ষার্থীর শেখার প্রক্রিয়াকে রূপদান করে।

৩. মূল্যবোধতত্ত্ব (Axiology): মূল্যবোধ ও শিক্ষার লক্ষ্য
মূল্যবোধতত্ত্ব মূল্যবোধের প্রকৃতি এবং মানদণ্ড নিয়ে আলোচনা করে। এর দুটি প্রধান শাখা:

  • ক) নীতিশাস্ত্র (Ethics): এটি নৈতিক আচরণ, ভালো-মন্দ, সঠিক-ভুল এবং কর্তব্যের মানদণ্ড নির্ধারণ করে।
  • খ) নন্দনতত্ত্ব (Aesthetics): এটি সৌন্দর্য, শিল্প এবং রুচিবোধের প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করে।
  • পাঠ্যক্রমে প্রভাব:
    • নীতিশাস্ত্র: পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কী ধরনের নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ (যেমন: সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সহানুভূতি, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা) গড়ে তোলা হবে, তা নীতিশাস্ত্র দ্বারা নির্ধারিত হয়। চরিত্র গঠন, মূল্যবোধের শিক্ষা এবং নাগরিক দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলা পাঠ্যক্রমের একটি আবশ্যিক অঙ্গ হয়ে ওঠে।
    • নন্দনতত্ত্ব: পাঠ্যক্রমে শিল্পকলা, সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক এবং সাহিত্যের মতো বিষয়গুলিকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৌন্দর্যবোধ, সৃজনশীলতা এবং নান্দনিক চেতনার বিকাশ ঘটানো হয়। এটি জীবনকে উপভোগ করার এবং সূক্ষ্ম অনুভূতিকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা তৈরি করে।

এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, দর্শন পাঠ্যক্রমের প্রতিটি স্তরে পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করে। এবার আমরা প্রধান দার্শনিক মতবাদগুলি কীভাবে পাঠ্যক্রমকে নির্দিষ্ট রূপ দিয়েছে, তা বিস্তারিতভাবে দেখব।

পাঠ্যক্রমের উপর পাশ্চাত্য দর্শনের প্রভাব

১. ভাববাদ (Idealism)

  • মূল ধারণা: ভাববাদ পাশ্চাত্য দর্শনের সবচেয়ে প্রাচীন মতবাদ, যার মূল প্রবক্তা প্লেটো। তাঁর মতে, আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎটি হলো আসল জগতের একটি ছায়া মাত্র। আসল জগৎ হলো ভাব বা ধারণার (Ideas) জগৎ, যা শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় এবং নিখুঁত। মানুষের আত্মা এই ভাবলোক থেকেই এসেছে, তাই শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো আত্ম-উপলব্ধি এবং এই শাশ্বত সত্য, শিব ও সুন্দরকে (Truth, Goodness, and Beauty) জীবনে প্রতিফলিত করা। আধুনিক যুগে এর প্রবক্তাদের মধ্যে রয়েছেন কান্ট, হেগেল, এবং ভারতীয় প্রেক্ষাপটে স্বামী বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
  • শিক্ষার লক্ষ্য:
    • আত্ম-উপলব্ধি: শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক ও বৌদ্ধিক সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ।
    • শাশ্বত মূল্যবোধের বিকাশ: নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চরিত্র গঠন করা।
    • সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও সঞ্চালন: মানবজাতির শ্রেষ্ঠ জ্ঞান ও সংস্কৃতিকে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছে দেওয়া।
  • পাঠ্যক্রম: ভাববাদী পাঠ্যক্রম বিষয়-কেন্দ্রিক (Subject-centered) এবং মননশীল।
    • বিষয়বস্তু: এখানে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয় মানবিক বিদ্যাকে (Humanities)। সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, ধর্ম, নীতিশাস্ত্র, শিল্পকলা এবং সঙ্গীত হলো মূল বিষয়, কারণ এগুলি শাশ্বত ধারণা ও মূল্যবোধের ধারক। গণিতকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়, কারণ এটি বিমূর্ত যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। বিজ্ঞানকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব দেওয়া হয়, কারণ এটি পরিবর্তনশীল বস্তুগত জগৎ নিয়ে আলোচনা করে।
    • সংগঠন: বিষয়গুলি একটি যৌক্তিক ಕ್ರಮ অনুসারে সাজানো থাকে, যা মানব মনের বিকাশের স্তরকে প্রতিফলিত করে।
  • শিক্ষণ পদ্ধতি: বক্তৃতা, প্রশ্নোত্তর (সক্রেটিসের পদ্ধতি), আলোচনা, বিতর্ক এবং মহান ব্যক্তিত্বদের অনুকরণ। লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীর চিন্তাকে উদ্দীপ্ত করা।
  • শিক্ষক ও শিক্ষার্থী: শিক্ষক হলেন একজন আদর্শ, আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক এবং জ্ঞানের মূর্ত প্রতীক। শিক্ষার্থী হলো এক আধ্যাত্মিক সত্তা, যাকে শৃঙ্খলা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে জ্ঞানার্জন করতে হয়।
  • শৃঙ্খলা: এখানে বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণের চেয়ে আত্ম-শৃঙ্খলা (Self-discipline) ও নৈতিক অনুশাসনের উপর জোর দেওয়া হয়।
  • সমালোচনা: ভাববাদী পাঠ্যক্রম বর্তমান জীবনের বাস্তব চাহিদা থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন এবং অবৈজ্ঞানিক বলে সমালোচিত হয়। তবে এর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিকটি চিরকালীন প্রাসঙ্গিক।

২. বাস্তববাদ (Realism)

  • মূল ধারণা: বাস্তববাদ ভাববাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। এরিস্টটলের হাত ধরে এর যাত্রা শুরু। বাস্তববাদীদের মতে, এই বস্তুগত জগৎই একমাত্র বাস্তবতা। এটি আমাদের মন-নিরপেক্ষ এবং এর নিজস্ব নিয়ম দ্বারা পরিচালিত। যুক্তি, পর্যবেক্ষণ এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে এই বাস্তব জগৎ সম্পর্কে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। জন লক, হার্বার্ট স্পেন্সার, বার্ট্রান্ড রাসেল এই ধারার প্রধান প্রবক্তা।
  • শিক্ষার লক্ষ্য:
    • বাস্তব জগতের জ্ঞান দান: শিক্ষার্থীকে তার পারিপার্শ্বিক জগৎ এবং প্রকৃতির নিয়মাবলী সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান প্রদান করা।
    • যৌক্তিক ক্ষমতার বিকাশ: বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাভাবনা, বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তৈরি করা।
    • সফল জীবনের প্রস্তুতি: শিক্ষার্থীকে বাস্তব জগতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে সজ্জিত করা।
  • পাঠ্যক্রম: বাস্তববাদী পাঠ্যক্রম অত্যন্ত সুসংগঠিত, বিষয়-কেন্দ্রিক এবং বিজ্ঞান-নির্ভর।
    • বিষয়বস্তু: প্রাকৃতিক বিজ্ঞান (পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান), গণিত, ভূগোল এবং প্রযুক্তির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভাষা ও ইতিহাসকেও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য হিসেবে পড়ানো হয়। কলা ও সাহিত্যকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়।
    • সংগঠন: পাঠ্যক্রম সহজ থেকে কঠিন, পরিচিত থেকে অপরিচিত—এই নীতিতে সংগঠিত হয়। প্রতিটি বিষয়ের একটি নির্দিষ্ট যৌক্তিক কাঠামো থাকে।
  • শিক্ষণ পদ্ধতি: বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, প্রদর্শন এবং তথ্যসমৃদ্ধ বক্তৃতা। এখানে জ্ঞানকে নির্ভুলভাবে সঞ্চালন করার উপর জোর দেওয়া হয়।
  • শিক্ষক ও শিক্ষার্থী: শিক্ষক হলেন একজন বিষয় বিশেষজ্ঞ (Subject Matter Expert), যিনি জ্ঞানের ভাণ্ডার এবং তথ্যের নির্ভুল পরিবেশক। শিক্ষার্থী হলো একজন যুক্তিবাদী প্রাণী, যার কাজ হলো সুশৃঙ্খলভাবে জ্ঞান অর্জন করা।
  • শৃঙ্খলা: নিয়মানুবর্তিতা এবং কঠোর শৃঙ্খলার উপর জোর দেওয়া হয়, কারণ প্রকৃতির জগতেও নিয়ম বিদ্যমান।
  • সমালোচনা: এই দর্শন শিক্ষার্থীর আবেগ, সৃজনশীলতা এবং ব্যক্তিগত আগ্রহকে উপেক্ষা করে। এটি শিক্ষাকে কিছুটা যান্ত্রিক ও নীরস করে তুলতে পারে।

৩. প্রকৃতিবাদ (Naturalism)

  • মূল ধারণা: “প্রকৃতিতে ফিরে চলো” (Return to Nature)—এই হলো প্রকৃতিবাদের মূলমন্ত্র। এর প্রধান প্রবক্তা জঁ-জাক রুশো। তাঁর মতে, প্রকৃতিই হলো চূড়ান্ত বাস্তবতা। মানব শিশু জন্মায় সৎ ও নিষ্পাপ হিসেবে, কিন্তু সমাজ ও তার কৃত্রিম নিয়মকানুন তাকে কলুষিত করে। তাই শিশুকে প্রকৃতির কোলে, কোনো রকম সামাজিক চাপ ছাড়া, স্বাধীনভাবে তার নিজস্ব গতিতে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে হবে।
  • শিক্ষার লক্ষ্য:
    • স্বাভাবিক বিকাশ: শিশুর অন্তর্নিহিত প্রবৃত্তি ও ক্ষমতার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ ঘটানো।
    • আত্মসংরক্ষণ ও সুখী জীবনযাপন: বর্তমান জীবনকে সুখী ও সফল করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন।
    • প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান: প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী জীবনযাপন করতে শেখা।
  • পাঠ্যক্রম: প্রকৃতিবাদী পাঠ্যক্রম শিশু-কেন্দ্রিক (Child-centered) এবং অভিজ্ঞতা-নির্ভর।
    • বিষয়বস্তু: এখানে কোনো ধরাবাঁধা পাঠ্যপুস্তক বা বিষয়তালিকা নেই। শিশুর বয়স, চাহিদা ও আগ্রহই পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করে। খেলাধুলা, বাগান করা, পশুপালন, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। রুশোর মতে, ১২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকে কোনো বই পড়তে দেওয়া উচিত নয়, তাকে শুধু অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে দিতে হবে (নেতিবাচক শিক্ষা)।
    • সংগঠন: পাঠ্যক্রম শিশুর মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের স্তর অনুযায়ী সাজানো থাকে।
  • শিক্ষণ পদ্ধতি: “হাতে-কলমে শিক্ষা” (Learning by Doing), পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ এবং খেলা-ভিত্তিক পদ্ধতি। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস।
  • শিক্ষক ও শিক্ষার্থী: শিক্ষক পর্দার আড়ালে থেকে একজন সহায়ক, পর্যবেক্ষক এবং পরিবেশের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। তিনি সরাসরি কোনো নির্দেশ দেন না। শিক্ষার্থী হলো শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু, যে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার সাথে নিজের আগ্রহ অনুযায়ী শেখে।
  • শৃঙ্খলা: এখানে শাস্তির কোনো স্থান নেই। প্রকৃতিই শিশুকে তার ভুলের পরিণাম ভোগ করিয়ে শিক্ষা দেবে (“Discipline by Natural Consequences”)।
  • সমালোচনা: এই দর্শন সমাজের ভূমিকা এবং সামাজিক ঐতিহ্যের গুরুত্বকে অস্বীকার করে, যা বাস্তবসম্মত নয়। শিশুর উপর অতিরিক্ত স্বাধীনতা আরোপ করলে তা বিপথগামী হতে পারে।

৪. প্রয়োগবাদ (Pragmatism)

  • মূল ধারণা: প্রয়োগবাদ একটি আধুনিক মার্কিন দর্শন, যার প্রধান রূপকার জন ডিউই। প্রয়োগবাদীদের মূল কথা হলো, কোনো ধারণার সত্যতা তার কার্যকারিতা বা উপযোগিতার উপর নির্ভরশীল (“Truth is what works”)। জগৎ পরিবর্তনশীল, তাই কোনো শাশ্বত সত্য বা চিরন্তন মূল্যবোধ নেই। জ্ঞান ও সত্য অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নির্মিত এবং পরিস্থিতির সাপেক্ষে পরিবর্তনীয়। শিক্ষা হলো জীবনের জন্য প্রস্তুতি নয়, শিক্ষাই জীবন।
  • শিক্ষার লক্ষ্য:
    • সামাজিক দক্ষতার বিকাশ: শিক্ষার্থীকে পরিবর্তনশীল সমাজের একজন দক্ষ, সহযোগিতাপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।
    • সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা অর্জন: জীবনের বাস্তব সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধান করার দক্ষতা তৈরি করা।
    • অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন: ক্রমাগত নতুন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নিজেকে উন্নত করা।
  • পাঠ্যক্রম: প্রয়োগবাদী পাঠ্যক্রম অভিজ্ঞতা-কেন্দ্রিক, নমনীয়, সমন্বিত এবং উপযোগিতা-ভিত্তিক।
    • বিষয়বস্তু: সেইসব বিষয় ও কার্যাবলীকে গুরুত্ব দেওয়া হয় যেগুলির বাস্তব জীবনে উপযোগিতা আছে। যেমন—স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, কৃষি, বৃত্তিমূলক শিক্ষা, সামাজিক বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান। বিষয়গুলিকে বিচ্ছিন্নভাবে না পড়িয়ে সমন্বিত (Integrated) প্রকল্পে রূপ দেওয়া হয়।
    • সংগঠন: পাঠ্যক্রম শিশুর আগ্রহ এবং সামাজিক চাহিদার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এটি সমস্যা-ভিত্তিক (Problem-centered)।
  • শিক্ষণ পদ্ধতি: প্রকল্প পদ্ধতি (Project Method), সমস্যা সমাধান পদ্ধতি, পরীক্ষামূলক পদ্ধতি এবং “হাতে-কলমে শিক্ষা”। দলবদ্ধভাবে কাজ করার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়।
  • শিক্ষক ও শিক্ষার্থী: শিক্ষক হলেন একজন বন্ধু, পথপ্রদর্শক এবং সহায়ক (Friend, Philosopher, and Guide)। তিনি শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে সাহায্য করেন। শিক্ষার্থী হলো একজন সক্রিয় সমস্যা সমাধানকারী, যে সামাজিক পরিবেশে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে জ্ঞান নির্মাণ করে।
  • শৃঙ্খলা: সামাজিক কার্যকলাপের মাধ্যমে অর্জিত আত্ম-শৃঙ্খলা এবং গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলার উপর জোর দেওয়া হয়।
  • সমালোচনা: প্রয়োগবাদ কোনো স্থায়ী মূল্যবোধ বা আধ্যাত্মিক লক্ষ্যে বিশ্বাস করে না, যা শিক্ষাকে লক্ষ্যহীন করে তুলতে পারে। এর উপযোগিতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি মানববিদ্যার মতো বিষয়গুলির গুরুত্বকে হ্রাস করে।

৫. অস্তিত্ববাদ (Existentialism)

  • মূল ধারণা: বিংশ শতাব্দীর এই দর্শনের মূল কথা হলো, “অস্তিত্ব সারধর্মের পূর্বগামী” (Existence precedes essence)। এর প্রবক্তা সোরেন কিয়ের্কেগার্ড, জঁ-পল সার্ত্র প্রমুখ। এর অর্থ হলো, মানুষ প্রথমে এই জগতে অস্তিত্ব লাভ করে, তারপর সে তার পছন্দ, স্বাধীনতা ও কর্মের মাধ্যমে নিজের পরিচয় বা সারধর্ম তৈরি করে। মানুষ তার নিজের জীবনের স্রষ্টা এবং সে তার পছন্দের জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী। ব্যক্তি-স্বাধীনতা, আত্ম-সচেতনতা এবং আত্মপরিচয় নির্মাণই এর কেন্দ্রবিন্দু।
  • শিক্ষার লক্ষ্য:
    • আত্ম-আবিষ্কার: শিক্ষার্থীকে তার নিজস্ব সত্তা, স্বাধীনতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করা।
    • ব্যক্তিগত অর্থ খুঁজে পাওয়া: জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে এবং নিজের মূল্যবোধ তৈরি করতে সাহায্য করা।
    • স্বাধীন পছন্দের ক্ষমতা বিকাশ: শিক্ষার্থীকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে এবং তার ফলাফলের দায়িত্ব নিতে শেখানো।
  • পাঠ্যক্রম: অস্তিত্ববাদী পাঠ্যক্রম ব্যক্তিনিষ্ঠ (Subjective) এবং নমনীয়।
    • বিষয়বস্তু: মানবিক বিদ্যা (Humanities) যেমন সাহিত্য, শিল্পকলা, নাটক, ইতিহাস, জীবনী এবং দর্শনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারণ এই বিষয়গুলি মানুষের অস্তিত্বের সংকট, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আনন্দ ও যন্ত্রণা বুঝতে সাহায্য করে। বিজ্ঞানকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়, কারণ তা বস্তুনিষ্ঠ ও নৈর্ব্যক্তিক।
    • সংগঠন: কোনো পূর্বনির্ধারিত বা বাধ্যতামূলক পাঠ্যক্রম থাকে না। শিক্ষার্থীর পছন্দ ও আগ্রহকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
  • শিক্ষণ পদ্ধতি: সক্রেটিক সংলাপ, আলোচনা, আত্ম-প্রতিফলন এবং সৃজনশীল কাজ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে একটি ব্যক্তিগত ও খোলামেলা সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
  • শিক্ষক ও শিক্ষার্থী: শিক্ষক জ্ঞান চাপিয়ে দেন না, বরং শিক্ষার্থীর আত্ম-আবিষ্কারের যাত্রায় সহায়কের ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষার্থী হলো একজন স্বাধীন সত্তা, যে সক্রিয়ভাবে নিজের শিক্ষা ও পরিচয় নির্মাণে অংশগ্রহণ করে।
  • শৃঙ্খলা: এখানে বাহ্যিক শৃঙ্খলার কোনো স্থান নেই। শিক্ষার্থী তার পছন্দের ফলাফলের জন্য দায়ী থাকবে, এটাই তার শৃঙ্খলা।
  • সমালোচনা: এই দর্শন অত্যন্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং সামাজিক দায়িত্ববোধকে উপেক্ষা করার সম্ভাবনা থাকে। এর কোনো সুসংগঠিত পাঠ্যক্রম না থাকায় বাস্তবায়ন করা কঠিন।

৬. মার্কসবাদ (Marxism)

  • মূল ধারণা: কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস প্রবর্তিত এই দর্শন একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক তত্ত্ব। এর মূল ভিত্তি হলো দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism) এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism)। মার্কসবাদের মতে, সমাজ শ্রেণি-বিভক্ত (শোষক ও শোষিত) এবং এই শ্রেণি-সংগ্রামই ইতিহাসের চালিকাশক্তি। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা শাসক শ্রেণির ভাবাদর্শকে টিকিয়ে রাখে এবং শোষণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
  • শিক্ষার লক্ষ্য:
    • শ্রেণি-চেতনা জাগ্রত করা: শোষিত শ্রেণিকে তাদের শোষণ সম্পর্কে সচেতন করা।
    • শ্রেণিহীন সমাজ গঠন: পুঁজিবাদের অবসান ঘটিয়ে একটি সাম্যবাদী বা শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
    • সর্বাত্মক বিকাশ: শ্রম ও শিক্ষার সমন্বয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মানসিক ও শারীরিক ক্ষমতার সর্বাত্মক বিকাশ ঘটানো।
  • পাঠ্যক্রম: মার্কসবাদী পাঠ্যক্রম সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার উপর প্রতিষ্ঠিত।
    • বিষয়বস্তু: ইতিহাস, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তবে এগুলিকে শ্রেণি-সংগ্রামের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়। উৎপাদনমূলক শ্রম ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে পাঠ্যক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখা হয় (Polytechnical Education)।
    • সংগঠন: পাঠ্যক্রম এমনভাবে সাজানো হয় যা সামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে।
  • শিক্ষণ পদ্ধতি: দলবদ্ধ আলোচনা, সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ এবং বাস্তব কাজের মাধ্যমে শিক্ষা।
  • শিক্ষক ও শিক্ষার্থী: শিক্ষক হলেন সামাজিক পরিবর্তনের একজন সক্রিয় কর্মী। শিক্ষার্থীকে প্রচলিত ব্যবস্থার সমালোচক এবং নতুন সমাজ গড়ার সৈনিক হিসেবে দেখা হয়।
  • সমালোচনা: এই দর্শন শিক্ষাকে রাজনৈতিক প্রচারের হাতিয়ারে পরিণত করতে পারে এবং ব্যক্তির স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করে। এর অতিমাত্রায় অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ সমালোচিত হয়।

পাঠ্যক্রমের উপর ভারতীয় দর্শনের প্রভাব

ভারতীয় দর্শন ঐতিহ্যগতভাবে জীবনমুখী এবং এর মূল লক্ষ্য হলো মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ। শিক্ষাকে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর সোপান হিসেবে দেখা হয়।

  • বৈদান্তিক দর্শন (বিশেষত অদ্বৈত বেদান্ত): আচার্য শংকর প্রবর্তিত এই দর্শনের মূল কথা “ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ”। অর্থাৎ, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, এবং জীবাত্মা সেই পরমাত্মারই অংশ। অবিদ্যা বা অজ্ঞতার কারণে মানুষ নিজেকে দেহ ও জগৎ থেকে ভিন্ন মনে করে। শিক্ষার লক্ষ্য হলো এই অজ্ঞতা দূর করে আত্ম-জ্ঞান বা মোক্ষ লাভ করা। এই দর্শন দ্বারা প্রভাবিত পাঠ্যক্রমে যোগ, ধ্যান, নীতিশাস্ত্র, শাস্ত্র অধ্যয়ন এবং আত্ম-অনুসন্ধানের উপর জোর দেওয়া হয়। এটি একটি সামগ্রিক (Holistic) শিক্ষার ধারণা দেয়।
  • বৌদ্ধ দর্শন: গৌতম বুদ্ধের দর্শন দুঃখের কারণ অনুসন্ধান এবং তা থেকে মুক্তির পথনির্দেশ করে। তাঁর আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ (সৎ বাক্য, সৎ কর্ম, সৎ জীবন ইত্যাদি) হলো একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-পাঠ্যক্রম। এই দর্শন দ্বারা প্রভাবিত পাঠ্যক্রমে অহিংসা, করুণা, মৈত্রী, সহনশীলতা এবং প্রজ্ঞার বিকাশের উপর জোর দেওয়া হয়। এটি শিক্ষার্থীর নৈতিক ও মানসিক বিকাশে গুরুত্ব আরোপ করে।
  • সাংখ্য-যোগ দর্শন: এই দর্শন অনুযায়ী, জগৎ প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগে গঠিত। যোগ দর্শনে চিত্তवृत्ति निरोध-এর মাধ্যমে কৈবল্য বা মোক্ষ লাভের কথা বলা হয়েছে। ইয়ম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি—এই অষ্টাঙ্গ যোগ হলো শরীর ও মনকে নিয়ন্ত্রণের একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। আধুনিক পাঠ্যক্রমে যোগ ও ধ্যানকে অন্তর্ভুক্ত করা এই দর্শনেরই প্রভাব, যা শিক্ষার্থীর মনোযোগ, মানসিক শান্তি এবং শারীরিক সুস্থতা বৃদ্ধি করে।

ভারতীয় দর্শনগুলি মূলত একটি অন্তর্মুখী, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলে, যা ব্যক্তির সামগ্রিক বিকাশে সহায়ক।

আধুনিক পাঠ্যক্রম: একটি সমন্বয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি

আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা কোনো একটিমাত্র দার্শনিক মতবাদকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে না। বরং এটি একটি সমন্বয়বাদী বা eclictic দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে, যেখানে বিভিন্ন দর্শনের সেরা এবং প্রাসঙ্গিক উপাদানগুলিকে প্রয়োজন অনুযায়ী সমন্বিত করা হয়। আজকের পাঠ্যক্রম হলো বহু দর্শনের একটি মিশ্রণ।

উদাহরণস্বরূপ, ভারতের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ (NEP 2020)-কে বিশ্লেষণ করলে এই সমন্বয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে:

  • প্রয়োগবাদ ও প্রকৃতিবাদের প্রভাব: হাতে-কলমে শিক্ষা (Experiential Learning), প্রকল্প-ভিত্তিক শিক্ষা, নমনীয় পাঠ্যক্রম, শিশুর আগ্রহকে গুরুত্ব দেওয়া এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি।
  • ভাববাদ ও ভারতীয় দর্শনের প্রভাব: সামগ্রিক বিকাশ (Holistic Development), নৈতিক ও সাংবিধানিক মূল্যবোধের শিক্ষা, ভারতীয় জ্ঞান-পরম্পরার অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠন।
  • বাস্তববাদের প্রভাব: বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গণিত (STEM)-এর উপর গুরুত্ব আরোপ এবং একবিংশ শতাব্দীর জন্য প্রয়োজনীয় বাস্তব দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্য।
  • অস্তিত্ববাদ ও মানবতাবাদের প্রভাব: শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা (Critical Thinking) এবং নিজস্ব প্রতিভা বিকাশের সুযোগ প্রদান।

এইভাবে, আধুনিক পাঠ্যক্রম বাস্তব জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা (বাস্তববাদ ও প্রয়োগবাদ), শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ (প্রকৃতিবাদ), নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ (ভাববাদ ও অস্তিত্ববাদ) এবং সামাজিক দায়িত্ববোধের (প্রয়োগবাদ) মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *