Overview of West Bengal Board of Secondary Education ( WBBSE)


 

 

পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ

(West Bengal Board of Secondary Education)

১. সাধারণ পরিচিতি (General Introduction)

পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ (West Bengal Board of Secondary Education বা WBBSE) হলো পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রধান এবং স্বশাসিত সংস্থা, যা রাজ্যের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নয়নের জন্য দায়বদ্ধ। ১৯৫০ সালের পশ্চিমবঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা আইন (West Bengal Secondary Education Act, 1950) অনুযায়ী, এই পর্ষদটি ১৯৫১ সালের ৩রা মে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর প্রধান কার্যালয় কলকাতার সল্টলেকে অবস্থিত, যার নাম ‘নিবেদিতা ভবন’।

পর্ষদের মূল উদ্দেশ্য হলো পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত অনুমোদিত বিদ্যালয়ে একটি সুসংহত এবং মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখা। এটি কেবল দশম শ্রেণির চূড়ান্ত পরীক্ষা, অর্থাৎ মাধ্যমিক পরীক্ষা (Madhyamik Pariksha) পরিচালনা করে না, বরং বিদ্যালয়গুলিকে স্বীকৃতি প্রদান, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি নির্ধারণ এবং শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নের জন্যও কাজ করে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ রাজ্যের লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ গঠনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এটি ভারতের অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহৎ শিক্ষা পর্ষদগুলির মধ্যে একটি। এর অধীনে থাকা বিদ্যালয়গুলির মাধ্যমে রাজ্যের প্রায় সমস্ত ছাত্রছাত্রী তাদের জীবনের প্রথম বড় পাবলিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। এই পরীক্ষার ফলাফল তাদের উচ্চতর শিক্ষার পথ এবং ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের दिशा নির্ধারণ করে।

পর্ষদের কাজের পরিধি বিশাল। এটি শুধুমাত্র শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়, বরং রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের কাছেও শিক্ষার সুযোগ পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর। পর্ষদ নিয়মিতভাবে পাঠ্যক্রম পর্যালোচনা করে এবং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে তাতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনে, যাতে ছাত্রছাত্রীরা আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হতে পারে।

 

২. পাঠ্যক্রম (Curriculum)

 




পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের পাঠ্যক্রমটি অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এবং ছাত্রছাত্রীদের সার্বিক বিকাশের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে। এর মূল লক্ষ্য হলো ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জ্ঞান, দক্ষতা এবং নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানো। দশম শ্রেণির (মাধ্যমিক) পাঠ্যক্রমটি মূলত কয়েকটি ভাগে বিভক্ত:

ক) আবশ্যিক বিষয় (Compulsory Subjects):
এই বিষয়গুলি সকল ছাত্রছাত্রীকে পড়তে হয়। মোট সাতটি আবশ্যিক বিষয় রয়েছে, এবং প্রতিটির জন্য ১০০ নম্বর ধার্য করা থাকে (৯০ লিখিত পরীক্ষা এবং ১০ অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন)।

      1. প্রথম ভাষা (First Language): ছাত্রছাত্রীরা তাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম অনুযায়ী প্রথম ভাষা নির্বাচন করে। বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীর জন্য এটি বাংলা। তবে হিন্দি, ইংরেজি, নেপালি, উর্দু, ওড়িয়া, সাঁওতালি ইত্যাদি ভাষাও প্রথম ভাষা হিসেবে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

      1. দ্বিতীয় ভাষা (Second Language): সকল ছাত্রছাত্রীর জন্য দ্বিতীয় ভাষা হলো ইংরেজি। এই বিষয়টির লক্ষ্য হলো ছাত্রছাত্রীদের ইংরেজি ভাষায় পড়া, লেখা এবং বলার দক্ষতা বৃদ্ধি করা।

      1. গণিত (Mathematics): পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি এবং ত্রিকোণমিতির মতো বিষয়গুলি এর অন্তর্ভুক্ত। ছাত্রছাত্রীদের যৌক্তিক চিন্তাভাবনা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ানোই এর মূল উদ্দেশ্য।

      1. ভৌতবিজ্ঞান (Physical Science): এই বিষয়টি দুটি ভাগে বিভক্ত – পদার্থবিদ্যা (Physics) এবং রসায়নবিদ্যা (Chemistry)। প্রাকৃতিক জগতের নিয়মকানুন এবং রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেওয়াই এর লক্ষ্য।

      1. জীবনবিজ্ঞান (Life Science): এই বিষয়ে উদ্ভিদবিদ্যা এবং প্রাণীবিদ্যা সম্পর্কে পড়ানো হয়। জীবজগৎ, মানবদেহ এবং পরিবেশ সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের সচেতন করে তোলা হয়।

      1. ইতিহাস (History): ভারত এবং বিশ্বের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা তাদের অতীত এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে।

      1. ভূগোল (Geography): প্রাকৃতিক এবং অর্থনৈতিক ভূগোল এর অন্তর্ভুক্ত। পৃথিবী, তার পরিবেশ, মানচিত্র এবং বিভিন্ন অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জ্ঞান প্রদান করা হয়।

    খ) ঐচ্ছিক অতিরিক্ত বিষয় (Optional Elective Subject):
    ছাত্রছাত্রীরা আবশ্যিক বিষয়গুলির পাশাপাশি একটি অতিরিক্ত বিষয় বেছে নিতে পারে। এই বিষয়ের নম্বর মোট নম্বরের সাথে যোগ হয় না, তবে কোনো আবশ্যিক বিষয়ে ফেল করলে এই বিষয়ের নম্বরটি শর্তসাপেক্ষে বিবেচিত হতে পারে। কিছু জনপ্রিয় ঐচ্ছিক বিষয় হলো:

        • কর্মশিক্ষা (Work Education)

        • শারীরশিক্ষা (Physical Education)

        • কম্পিউটার সায়েন্স (Computer Science)

        • বিভিন্ন ভোকেশনাল বিষয়

      মূল্যায়ন পদ্ধতি:
      প্রতিটি আবশ্যিক বিষয়ের জন্য মোট নম্বর ১০০। এর মধ্যে ৯০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা (বার্ষিক মাধ্যমিক পরীক্ষা) পর্ষদ দ্বারা পরিচালিত হয় এবং বাকি ১০ নম্বর অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের (Internal Assessment) জন্য বরাদ্দ থাকে, যা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়। এই অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের মধ্যে প্রজেক্ট ওয়ার্ক, ক্লাস টেস্ট ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই পদ্ধতি ছাত্রছাত্রীদের ধারাবাহিক মূল্যায়নে সাহায্য করে।

      ৩. পরিচালনা পর্ষদ (Governing Body)

      পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ একটি স্বশাসিত (Autonomous) এবং বিধিবদ্ধ (Statutory) সংস্থা হওয়ায় এর একটি সুনির্দিষ্ট পরিচালনা পর্ষদ রয়েছে। এই পর্ষদই সংস্থার সমস্ত নীতি নির্ধারণ এবং প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্কুল শিক্ষা দপ্তরের অধীনে এটি কাজ করে।

      পরিচালনা পর্ষদের গঠনটি বেশ व्यापक এবং এতে শিক্ষা জগতের বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাতে একটি ভারসাম্য বজায় থাকে। এর গঠন সাধারণত নিম্নলিখিত সদস্যদের নিয়ে হয়:

          1. সভাপতি (President): পর্ষদের প্রধান হলেন সভাপতি। রাজ্য সরকার কর্তৃক তিনি নিযুক্ত হন। পর্ষদের সমস্ত সভা তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় এবং তিনি পর্ষদের সামগ্রিক কাজকর্মের তত্ত্বাবধান করেন।

          1. সচিব (Secretary): সচিব হলেন পর্ষদের প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা (Chief Executive Officer)। তিনি পর্ষদের দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করেন, যেমন— পরীক্ষা আয়োজন, ফলাফল প্রকাশ, এবং অন্যান্য দাপ্তরিক কাজকর্ম।

          1. পর্ষদের সদস্য (Members of the Board): সভাপতি ও সচিব ছাড়াও পর্ষদে আরও অনেক সদস্য থাকেন। এই সদস্যরা বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে আসেন, যেমন:
                • পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি।

                • প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি।

                • রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের প্রতিনিধি।

                • রাজ্য বিধানসভার নির্বাচিত সদস্য (বিধায়ক)।

                • সরকার মনোনীত বিভিন্ন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক/শিক্ষিকা।

                • শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকগণ।

                • শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধি।

          পরিচালনা পর্ষদের প্রধান কাজ:

              • মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য নীতি ও পরিকল্পনা তৈরি করা।

              • রাজ্যের বিদ্যালয়গুলিকে স্বীকৃতি (Recognition) প্রদান করা বা প্রয়োজনে স্বীকৃতি বাতিল করা।

              • পাঠ্যক্রম এবং পাঠ্যসূচি অনুমোদন ও পরিবর্তন করা।

              • মাধ্যমিক পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা এবং সময়মতো ফলাফল প্রকাশ করা।

              • পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ ও বিতরণ ব্যবস্থার তত্ত্বাবধান করা।

              • শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

              • পর্ষদের আর্থিক ও প্রশাসনিক বিষয়গুলি পরিচালনা করা।

            এই পরিচালনা পর্ষদ নিশ্চিত করে যে পর্ষদের সমস্ত সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেওয়া হচ্ছে এবং রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

            ৪. বিষয় ও বিদ্যালয়ের সংখ্যা (Number of Subjects and Schools)

            বিদ্যালয়ের সংখ্যা:
            পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অধীনে অনুমোদিত বিদ্যালয়ের সংখ্যা বিপুল। পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ১২,০০০-এরও বেশি বিদ্যালয় এই পর্ষদের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। এই বিদ্যালয়গুলির মধ্যে রয়েছে:

                • সরকারি বিদ্যালয় (Government Schools)

                • সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয় (Government-sponsored/aided Schools)

                • বেসরকারি বিদ্যালয় (Private/Unaided Schools)

              এই বিশাল সংখ্যক বিদ্যালয়ের মাধ্যমে পর্ষদ রাজ্যের প্রায় প্রতিটি কোণায়, শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত, লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর কাছে মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ পৌঁছে দেয়। প্রতি বছর ১০ থেকে ১১ লক্ষের বেশি পরীক্ষার্থী মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে, যা পর্ষদের কাজের বিশাল পরিধিকে তুলে ধরে।

              বিষয়ের সংখ্যা:
              পর্ষদের পাঠ্যক্রমে বিষয়গুলির একটি নির্দিষ্ট কাঠামো রয়েছে।

                  • আবশ্যিক বিষয়: মোট ৭টি আবশ্যিক বিষয় রয়েছে, যা সকল ছাত্রছাত্রীকে পড়তে হয়। এগুলি হলো: প্রথম ভাষা, দ্বিতীয় ভাষা (ইংরেজি), গণিত, ভৌতবিজ্ঞান, জীবনবিজ্ঞান, ইতিহাস এবং ভূগোল।

                  • ঐচ্ছিক বিষয়: আবশ্যিক বিষয় ছাড়াও, ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রায় ৫০টিরও বেশি ঐচ্ছিক বা অতিরিক্ত বিষয়ের তালিকা রয়েছে। এই বিষয়গুলির মধ্যে যেমন প্রচলিত বিষয় (যেমন— কম্পিউটার সায়েন্স) রয়েছে, তেমনই বিভিন্ন বৃত্তিমূলক (Vocational) বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত আছে। এর ফলে ছাত্রছাত্রীরা তাদের আগ্রহ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনুযায়ী বিষয় বেছে নেওয়ার সুযোগ পায়।

                পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ কেবল একটি পরীক্ষ নিয়ামক সংস্থা নয়, এটি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থার এক স্তম্ভ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি রাজ্যের সামাজিক ও শিক্ষাগত উন্নয়নে অবিচ্ছিন্নভাবে অবদান রেখে চলেছে। লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ নির্মাণ এবং একটি শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। সময়ের সাথে সাথে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং পাঠ্যক্রমের সংস্কারের মাধ্যমে পর্ষদ নিজেকে ক্রমাগত উন্নত করার চেষ্টা করে চলেছে।

                Similar Posts

                Leave a Reply

                Your email address will not be published. Required fields are marked *