Pavlov : Learning Theory(Classical Conditioning)
প্যাভলভের শিখন তত্ত্ব (Pavlov’s Theory of Learning):
মনোবিজ্ঞানের জগতে “শিখন” (Learning) একটি কেন্দ্রীয় ধারণা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীরা প্রতিনিয়ত পরিবেশের সাথে অভিযোজন করার জন্য নতুন জ্ঞান, দক্ষতা, এবং আচরণ অর্জন করে। এই শিখন প্রক্রিয়া কীভাবে ঘটে, তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তত্ত্ব প্রদান করেছেন। এই তত্ত্বগুলির মধ্যে আচরণবাদী (Behaviourist) দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আচরণবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, শিখন হলো উদ্দীপক (Stimulus) এবং প্রতিক্রিয়ার (Response) মধ্যে সংযোগ স্থাপনের ফল এবং এটি মূলত পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণের মাধ্যমেই বোঝা সম্ভব।
আচরণবাদী মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে রাশিয়ান শারীরতত্ত্ববিদ (Physiologist) আইভান পেত্রোভিচ প্যাভলভ (Ivan Petrovich Pavlov) -এর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। যদিও তিনি মূলত পরিপাকতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করে ১৯০৪ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর সেই গবেষণার সূত্র ধরেই তিনি শিখন সম্পর্কিত এক যুগান্তকারী তত্ত্ব আবিষ্কার করেন, যা “প্রাচীন অনুবর্তন তত্ত্ব” বা “Classical Conditioning Theory” নামে পরিচিত। এই তত্ত্বটি শিখনের একটি মৌলিক প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করে, যেখানে একটি নিরপেক্ষ উদ্দীপক একটি স্বাভাবিক, সহজাত প্রতিক্রিয়ার সাথে যুক্ত হয়ে নতুন আচরণ তৈরি করে। এই প্রবন্ধে আমরা প্যাভলভের জীবন, তাঁর বিখ্যাত পরীক্ষা, তত্ত্বের মূল উপাদান, নীতিসমূহ, শিক্ষাক্ষেত্রে এর প্রয়োগ এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
আইভান প্যাভলভের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
আইভান প্যাভলভ ১৮৪৯ সালে রাশিয়ার একটি ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন ধর্মযাজক এবং প্যাভলভ নিজেও প্রথমে ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ তাঁকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের দিকে নিয়ে যায়। তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শারীরতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং পরিপাকতন্ত্রের উপর গবেষণা শুরু করেন। তাঁর গবেষণার মূল বিষয় ছিল, কীভাবে লালা এবং পাচক রস খাদ্য হজমে সহায়তা করে। এই গবেষণা করার সময়ই তিনি একটি অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করেন, যা তাঁকে মনোবিজ্ঞানের জগতে অমর করে রেখেছে। তিনি দেখেন যে, কুকুরদের কেবল খাবার দিলেই লালাক্ষরণ হয় না, বরং খাবার নিয়ে আসা ব্যক্তির পায়ের শব্দ বা খাবারের পাত্র দেখার পরেও তাদের লালাক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। এই পর্যবেক্ষণটিই তাঁকে অনুবর্তন তত্ত্ব আবিষ্কারের পথে চালিত করে।
প্যাভলভের বিখ্যাত পরীক্ষা (The Famous Experiment):
প্যাভলভের তত্ত্বটি তাঁর কুকুরের উপর করা একটি নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষণের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। এই পরীক্ষাটি শিখনের প্রক্রিয়াকে বৈজ্ঞানিকভাবে বোঝার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। পরীক্ষাটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়েছিল।
পরীক্ষার প্রস্তুতি:
প্যাভলভ একটি শব্দরোধী (sound-proof) পরীক্ষাগারে একটি কুকুরকে এমনভাবে একটি স্ট্যান্ডে বেঁধে রাখতেন যাতে সে বেশি নড়াচড়া করতে না পারে। এরপর তিনি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কুকুরের গাল থেকে একটি নল বের করে আনেন, যা একটি পরিমাপক যন্ত্রের সাথে যুক্ত ছিল। এর মাধ্যমে কুকুরের মুখ থেকে নিঃসৃত লালার পরিমাণ নিখুঁতভাবে মাপা যেত।
পরীক্ষার পর্যায়সমূহ:
প্যাভলভের পরীক্ষাটিকে তিনটি প্রধান পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে:
১. অনুবর্তনের পূর্ববর্তী পর্যায় (Stage Before Conditioning):
এই পর্যায়ে প্যাভলভ দুটি স্বাভাবিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন:
- স্বাভাবিক উদ্দীপক ও স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া: তিনি কুকুরের সামনে কিছু মাংসের গুঁড়ো (খাদ্য) উপস্থাপন করেন। খাদ্য হলো একটি স্বাভাবিক বা অনপেক্ষ উদ্দীপক (Unconditioned Stimulus – UCS), কারণ এর জন্য কোনো প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না। খাদ্য দেখার সাথে সাথে কুকুরের মুখ থেকে লালা নিঃসৃত হতে শুরু করে। এই লালাক্ষরণ হলো একটি স্বাভাবিক বা অনপেক্ষ প্রতিক্রিয়া (Unconditioned Response – UCR), কারণ এটি একটি সহজাত, অপরিবর্তনীয় এবং জন্মগত দৈহবৃত্তীয় প্রক্রিয়া।
- সমীকরণ: খাদ্য (UCS) → লালাক্ষরণ (UCR)
- নিরপেক্ষ উদ্দীপক: এরপর প্যাভলভ একটি ঘণ্টার শব্দ (bell sound) করেন। এই ঘণ্টার শব্দটি ছিল একটি নিরপেক্ষ উদ্দীপক (Neutral Stimulus – NS), কারণ স্বাভাবিক অবস্থায় এই শব্দের সাথে লালাক্ষরণের কোনো সম্পর্ক নেই। ঘণ্টার শব্দ শুনে কুকুরটি হয়তো কান খাড়া করেছিল বা শব্দের উৎসের দিকে তাকিয়েছিল, কিন্তু তার লালাক্ষরণ হয়নি।
- সমীকরণ: ঘণ্টার শব্দ (NS) → কোনো লালাক্ষরণ নেই
২. অনুবর্তন চলাকালীন পর্যায় (Stage During Conditioning):
এই পর্যায়ে প্যাভলভ শিখন প্রক্রিয়াটি শুরু করেন। তিনি নিরপেক্ষ উদ্দীপক (ঘণ্টার শব্দ) এবং স্বাভাবিক উদ্দীপক (খাদ্য)-কে একসাথে উপস্থাপন করতে শুরু করেন। crucial ব্যাপারটি হলো, তিনি প্রথমে ঘণ্টার শব্দ করতেন এবং তার ঠিক কয়েক সেকেন্ড পরেই কুকুরকে খাবার দিতেন। এই প্রক্রিয়াটি তিনি বারবার পুনরাবৃত্তি করেন।
- উদ্দীপকের সংযোগ: ঘণ্টার শব্দ (NS) এবং খাদ্য (UCS) একসাথে বা পরপর উপস্থাপন করার ফলে কুকুরের মস্তিষ্কে এই দুটি উদ্দীপকের মধ্যে একটি সংযোগ বা অনুষঙ্গ (association) তৈরি হতে শুরু করে। কুকুরটি শিখতে শুরু করে যে, ঘণ্টার শব্দ মানেই খাবার আসছে। এই পর্যায়েও লালাক্ষরণ হতো, কিন্তু তা খাদ্যের উপস্থিতির কারণেই হতো (UCR)।
- সমীকরণ: ঘণ্টার শব্দ (NS) + খাদ্য (UCS) → লালাক্ষরণ (UCR)

৩. অনুবর্তনের পরবর্তী পর্যায় (Stage After Conditioning):
বারবার ঘণ্টার শব্দের সাথে খাবার দেওয়ার পর এমন একটি সময় আসে যখন প্যাভলভ শুধুমাত্র ঘণ্টার শব্দ করেন, কিন্তু কোনো খাবার দেন না। তিনি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেন যে, খাবার না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ঘণ্টার শব্দ শুনেই কুকুরের মুখ থেকে লালা নিঃসৃত হচ্ছে।
- সাপেক্ষ উদ্দীপক ও সাপেক্ষ প্রতিক্রিয়া: এই পর্যায়ে, পূর্বে যে ঘণ্টার শব্দটি একটি নিরপেক্ষ উদ্দীপক (NS) ছিল, তা এখন একটি সাপেক্ষ বা অনুবর্তিত উদ্দীপক (Conditioned Stimulus – CS) -এ পরিণত হয়েছে। কারণ, কুকুরটি এখন এই শব্দের সাথে খাদ্যের আগমনকে যুক্ত করতে শিখেছে। আর এই সাপেক্ষ উদ্দীপকের (CS) প্রভাবে যে লালাক্ষরণ হচ্ছে, তাকে বলা হয় সাপেক্ষ বা অনুবর্তিত প্রতিক্রিয়া (Conditioned Response – CR)। এই প্রতিক্রিয়াটি অর্জিত বা শিখনের ফল।
- সমীকরণ: ঘণ্টার শব্দ (CS) → লালাক্ষরণ (CR)
এই পরীক্ষার মাধ্যমে প্যাভলভ প্রমাণ করেন যে, একটি নিরপেক্ষ উদ্দীপকও বারবার স্বাভাবিক উদ্দীপকের সাথে যুক্ত হওয়ার ফলে স্বাভাবিক উদ্দীপকের মতোই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। এই প্রক্রিয়াটিই হলো প্রাচীন অনুবর্তন।
প্রাচীন অনুবর্তন তত্ত্বের মূল উপাদান (Key Components of Classical Conditioning):
প্যাভলভের তত্ত্বকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য এর পাঁচটি মূল উপাদান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন:
- অনপেক্ষ উদ্দীপক (Unconditioned Stimulus – UCS): এটি এমন একটি উদ্দীপক যা স্বাভাবিকভাবেই, কোনো পূর্ব প্রশিক্ষণ ছাড়াই, একটি নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। প্যাভলভের পরীক্ষায় খাদ্য ছিল UCS।
- অনপেক্ষ প্রতিক্রিয়া (Unconditioned Response – UCR): এটি হলো অনপেক্ষ উদ্দীপকের (UCS) প্রতি একটি স্বাভাবিক, সহজাত এবং অপরিবর্তনীয় প্রতিক্রিয়া। পরীক্ষায় খাদ্যের প্রতি লালাক্ষরণ ছিল UCR।
- নিরপেক্ষ উদ্দীপক (Neutral Stimulus – NS): এটি এমন একটি উদ্দীপক যা অনুবর্তনের আগে কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া (যেমন, লালাক্ষরণ) সৃষ্টি করে না। পরীক্ষার শুরুতে ঘণ্টার শব্দটি ছিল NS।
- সাপেক্ষ উদ্দীপক (Conditioned Stimulus – CS): যখন একটি নিরপেক্ষ উদ্দীপক (NS) বারবার অনপেক্ষ উদ্দীপকের (UCS) সাথে যুক্ত হওয়ার ফলে কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করার ক্ষমতা অর্জন করে, তখন তাকে সাপেক্ষ উদ্দীপক বলে। পরীক্ষায় ঘণ্টার শব্দটি পরে CS-এ পরিণত হয়েছিল।
- সাপেক্ষ প্রতিক্রিয়া (Conditioned Response – CR): সাপেক্ষ উদ্দীপকের (CS) প্রতি অর্জিত বা শিখনের ফলে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তাকে সাপেক্ষ প্রতিক্রিয়া বলে। ঘণ্টার শব্দ শুনে লালাক্ষরণ ছিল CR।
প্রাচীন অনুবর্তনের নীতি বা সূত্রসমূহ (Principles of Classical Conditioning):
প্যাভলভ তাঁর গবেষণার মাধ্যমে অনুবর্তন প্রক্রিয়ার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি বা সূত্র আবিষ্কার করেন, যা শিখনের প্রকৃতিকে আরও গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করে।
- অধিগ্রহণ (Acquisition): এটি হলো সেই পর্যায় যেখানে CS এবং UCS-এর বারবার উপস্থাপনের মাধ্যমে CR (সাপেক্ষ প্রতিক্রিয়া) শক্তিশালী হয়। অর্থাৎ, জীব CS এবং UCS-এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে শেখে। অধিগ্রহণের গতি নির্ভর করে CS এবং UCS উপস্থাপনের সময়গত ব্যবধানের উপর। প্যাভলভ দেখেন যে, CS উপস্থাপনের ঠিক পরেই (প্রায় ০.৫ সেকেন্ড) UCS উপস্থাপন করলে অনুবর্তন সবচেয়ে দ্রুত এবং শক্তিশালী হয়।
- অপানুবর্তন বা বিলোপ (Extinction): যদি অনুবর্তন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বারবার শুধুমাত্র সাপেক্ষ উদ্দীপক (CS) উপস্থাপন করা হয় কিন্তু তার সাথে অনপেক্ষ উদ্দীপক (UCS) দেওয়া না হয়, তবে ধীরে ধীরে সাপেক্ষ প্রতিক্রিয়া (CR) দুর্বল হতে হতে একসময় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াকে অপানুবর্তন বা বিলোপ বলে। যেমন, বারবার শুধু ঘণ্টার শব্দ করার পর খাবার না দিলে কুকুর একসময় ঘণ্টার শব্দে লালাক্ষরণ বন্ধ করে দেবে।
- স্বতঃস্ফূর্ত প্রত্যাবর্তন (Spontaneous Recovery): অপানুবর্তন ঘটে যাওয়ার পর যদি কিছু সময় (কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিন) বিরতি দিয়ে পুনরায় সাপেক্ষ উদ্দীপক (CS) উপস্থাপন করা হয়, তবে দেখা যায় যে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সাপেক্ষ প্রতিক্রিয়া (CR) আবার ফিরে আসে, যদিও তার তীব্রতা আগের চেয়ে কম থাকে। এই ঘটনাকে স্বতঃস্ফূর্ত প্রত্যাবর্তন বলে। এটি প্রমাণ করে যে, অপানুবর্তনের ফলে শিখন পুরোপুরি মুছে যায় না, বরং সাময়িকভাবে চাপা পড়ে থাকে।
- উদ্দীপকের সাধারণীকরণ (Stimulus Generalization): অনুবর্তন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রাণী শুধু মূল সাপেক্ষ উদ্দীপকের (CS) প্রতিই প্রতিক্রিয়া করে না, বরং তার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ অন্যান্য উদ্দীপকের প্রতিও একই রকম প্রতিক্রিয়া করে। এই প্রক্রিয়াকে উদ্দীপকের সাধারণীকরণ বলে। যেমন, প্যাভলভের কুকুরটি শুধু নির্দিষ্ট ঘণ্টার শব্দের প্রতিই নয়, বরং কাছাকাছি সুরের অন্যান্য ঘণ্টার শব্দ বা বাজার (buzzer)-এর শব্দ শুনেও লালাক্ষরণ করতে পারে। বাস্তব জীবনে, যে শিশু একটি নির্দিষ্ট সাদা কুকুরকে ভয় পায়, সে সব সাদা লোমশ প্রাণীকে ভয় পেতে শুরু করতে পারে।
- উদ্দীপকের পৃথকীকরণ (Stimulus Discrimination): এটি সাধারণীকরণের বিপরীত প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় প্রাণী মূল সাপেক্ষ উদ্দীপক (CS) এবং অন্যান্য সাদৃশ্যপূর্ণ উদ্দীপকের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখে। যদি শুধুমাত্র মূল CS-এর সাথেই UCS (খাবার) দেওয়া হয় এবং অন্যান্য সাদৃশ্যপূর্ণ উদ্দীপকের সাথে UCS না দেওয়া হয়, তবে প্রাণী একসময় শুধু মূল CS-এর প্রতিই প্রতিক্রিয়া করতে শেখে, অন্যগুলোর প্রতি করে না। যেমন, প্যাভলভ যদি শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের ঘণ্টার শব্দের সাথে খাবার দিতেন এবং অন্য কম্পাঙ্কের শব্দের সাথে না দিতেন, তাহলে কুকুরটি একসময় শুধু সেই নির্দিষ্ট ঘণ্টার শব্দেই লালাক্ষরণ করত।
শিক্ষাক্ষেত্রে প্যাভলভের তত্ত্বের প্রয়োগ ও গুরুত্ব (Educational Implications of Pavlov’s Theory):
যদিও প্যাভলভের তত্ত্বটি প্রাণীর উপর গবেষণার ফল, মানুষের শিখন, বিশেষ করে আবেগ এবং অভ্যাস গঠনের ক্ষেত্রে এর গভীর প্রভাব রয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এই তত্ত্বের প্রয়োগগুলি নিম্নরূপ:
- সু-অভ্যাস গঠন: এই তত্ত্বের সাহায্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভালো অভ্যাস যেমন—সময়ানুবর্তিতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদি গঠন করা যায়। যেমন, প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে পড়াশোনা শুরু করার আগে একটি মনোরম গান বাজালে (CS), পড়াশোনার প্রতি একটি ইতিবাচক মনোভাব (CR) তৈরি হতে পারে। স্কুলের ঘণ্টা বাজলেই ক্লাস শুরু হওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়াও এর একটি উদাহরণ।
- কু-অভ্যাস ও ভীতি দূরীকরণ: অপানুবর্তন এবং প্রতি-অনুবর্তন (Counter-conditioning) নীতির সাহায্যে শিক্ষার্থীদের অযৌক্তিক ভয়, উদ্বেগ এবং খারাপ অভ্যাস দূর করা সম্ভব। যেমন, কোনো শিশুর যদি অঙ্কভীতি (CS) থাকে, তাহলে একজন স্নেহশীল শিক্ষক (নতুন UCS) যদি মজার খেলার মাধ্যমে অঙ্ক করান, তবে ধীরে ধীরে অঙ্কের প্রতি ভয় কমে গিয়ে ভালোবাসা তৈরি হতে পারে। একেই প্রতি-অনুবর্তন বলা হয়, যেখানে একটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তে একটি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া স্থাপন করা হয়।
- দৃষ্টি-শ্রুতি উপকরণের ব্যবহার: শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা চার্ট, মডেল, ছবি বা মাল্টিমিডিয়া (CS) ব্যবহার করে পাঠ্য বিষয়কে (UCS) আকর্ষণীয় করে তোলেন। এর ফলে শিক্ষার্থীরা বিমূর্ত ধারণার সাথে মূর্ত বস্তুর সংযোগ স্থাপন করতে পারে এবং তাদের শিখন স্থায়ী হয়। যেমন, ‘আপেল’ শব্দটি শেখানোর সময় একটি বাস্তব আপেল বা তার ছবি দেখালে শব্দটি ও বস্তুটি തമ്മിൽ একটি দৃঢ় মানসিক সংযোগ তৈরি হয়।
- মনোভাব গঠন: শিক্ষার্থীদের কোনো বিষয়, শিক্ষক বা বিদ্যালয়ের প্রতি মনোভাব তৈরিতে অনুবর্তন তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একজন শিক্ষক যদি রুঢ় আচরণ (UCS) করেন, তবে শিক্ষার্থীরা সেই শিক্ষক এবং তাঁর পড়ানো বিষয়ের (CS) প্রতি একটি নেতিবাচক মনোভাব (CR) তৈরি করতে পারে। বিপরীতভাবে, একজন স্নেহশীল ও উৎসাহব্যঞ্জক শিক্ষকের সান্নিধ্যে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলে।
- পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবহার: যদিও এটি স্কিনারের оперант অনুবর্তনের মূল বিষয়, প্রাচীন অনুবর্তনেরও এখানে ভূমিকা আছে। বিদ্যালয়ের নিয়মকানুন (CS) এবং তার সাথে সম্পর্কিত পুরস্কার বা তিরস্কার (UCS) শিক্ষার্থীদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ (CR) তৈরি করতে সাহায্য করে।
তত্ত্বের সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা (Criticism and Limitations of the Theory):
প্যাভলভের তত্ত্ব মনোবিজ্ঞানে একটি বিপ্লব আনলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা পরবর্তীকালে অন্যান্য মনোবিজ্ঞানীরা তুলে ধরেছেন।
- যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি: সমালোচকদের মতে, এই তত্ত্বটি মানুষ এবং প্রাণীকে একটি নিষ্ক্রিয় যন্ত্র হিসেবে দেখে, যারা কেবল উদ্দীপকের প্রতি প্রতিক্রিয়া করে। এটি মানুষের উচ্চতর মানসিক প্রক্রিয়া যেমন—চিন্তা, বিচার, বুদ্ধি, অন্তর্দৃষ্টি (insight) এবং সৃজনশীলতাকে উপেক্ষা করে। মানুষ কেবল উদ্দীপকের দাস নয়, সে সক্রিয়ভাবে পরিবেশকে ব্যাখ্যা করে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
- শিখনের সীমাবদ্ধ ব্যাখ্যা: প্রাচীন অনুবর্তন মূলত সহজাত এবং অনৈচ্ছিক প্রতিক্রিয়া (involuntary responses) যেমন—লালাক্ষরণ, ভয়, আবেগ ইত্যাদির শিখনকে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু জটিল, ঐচ্ছিক (voluntary) এবং উদ্দেশ্যমূলক আচরণ যেমন—সাইকেল চালানো, অঙ্ক করা বা একটি প্রবন্ধ লেখা—এই তত্ত্ব দিয়ে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। এই ধরনের শিখন ব্যাখ্যা করার জন্য স্কিনারের “সক্রিয় অনুবর্তন তত্ত্ব” (Operant Conditioning) অধিক উপযোগী।
- জ্ঞানীয় উপাদানের উপেক্ষা: আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, অনুবর্তনের জন্য শুধুমাত্র CS এবং UCS-এর সংযোগই যথেষ্ট নয়, শিক্ষার্থীর জ্ঞানীয় প্রক্রিয়া বা উপলব্ধিও (cognition) গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীকে বুঝতে হবে যে CS আসলে UCS-এর আগমন সম্পর্কে একটি সংকেত দিচ্ছে। প্যাভলভের তত্ত্বে এই জ্ঞানীয় দিকটি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত।
- প্রাণীর উপর গবেষণা: তত্ত্বটি মূলত প্রাণীর উপর করা গবেষণার ফল। মানুষের শিখন প্রক্রিয়া প্রাণীর চেয়ে অনেক বেশি জটিল, কারণ এতে ভাষা, সংস্কৃতি, সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মতো বিষয়গুলি জড়িত থাকে। তাই প্রাণীর গবেষণার ফলাফল সরাসরি মানুষের উপর প্রয়োগ করা সবসময় সঠিক নাও হতে পারে।
উপরে উল্লিখিত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, শিখন মনোবিজ্ঞানের ইতিহাসে আইভান প্যাভলভের প্রাচীন অনুবর্তন তত্ত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। এটিই প্রথম তত্ত্ব যা শিখনের মতো একটি মানসিক প্রক্রিয়াকে পরীক্ষাগারে নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় বৈজ্ঞানিকভাবে পরিমাপ করতে সক্ষম হয়েছিল। এই তত্ত্ব আচরণবাদের ভিত্তি স্থাপন করেছিল এবং মনোবিজ্ঞানকে একটি বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানে পরিণত করতে সাহায্য করেছিল।
প্যাভলভ দেখিয়েছেন যে, আমাদের অনেক আবেগ, ভয়, পছন্দ-অপছন্দ এবং অভ্যাস আমাদের অজান্তেই অনুবর্তনের মাধ্যমে গঠিত হয়। শিক্ষাক্ষেত্র থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন এবং মানসিক চিকিৎসার (যেমন—ফোবিয়া দূরীকরণে Systemic Desensitization) জগতে আজও প্যাভলভের নীতির সফল প্রয়োগ দেখা যায়। যদিও এটি শিখনের সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরে না, তবে এটি শিখন প্রক্রিয়ার একটি মৌলিক এবং অপরিহার্য অংশকে আলোকিত করে। তাই, প্যাভলভের তত্ত্বকে শিখনের একটি আংশিক কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা হিসেবেই গণ্য করা হয়, যা পরবর্তীকালের অনেক তত্ত্বের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে।
One Comment