(“মধ্যযুগীয় ভারতে ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন ছিল? জানুন মকতব, মাদ্রাসা, পাঠ্যক্রম, নারীশিক্ষা এবং সুলতানি ও মুঘল শাসকদের অবদান। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য MCQ সহ সম্পূর্ণ নোট।”)
ভারতে মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠা (আনুমানিক ১২শ শতক) দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এক গভীর পরিবর্তন নিয়ে আসে। এই পরিবর্তনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল শিক্ষা ব্যবস্থার রূপান্তর। প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি এক নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যা ছিল মূলত ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি কেন্দ্রিক। সুলতানি যুগ থেকে শুরু করে মুঘল যুগের অবসান পর্যন্ত, প্রায় ছয় শতাব্দী ধরে এই শিক্ষা ব্যবস্থা ভারতের জ্ঞানচর্চার জগতে এক প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছিল।
এই শিক্ষা ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম ধর্মের প্রচার, প্রসার এবং মুসলিম শাসকদের জন্য প্রশাসনিক কাজে দক্ষ কর্মচারী তৈরি করা। পাশাপাশি, ইসলামিক সংস্কৃতি, সাহিত্য, দর্শন ও আইনশাস্ত্রের চর্চাও এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল। এই ব্যবস্থার প্রধান দুটি প্রতিষ্ঠান ছিল মকতব (Maktab) বা প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসা (Madrasa) বা উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র। এই বিস্তারিত আলোচনায় আমরা মধ্যযুগীয় ভারতে ইসলামিক শিক্ষার বিভিন্ন দিক, যেমন— লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, কাঠামো, পাঠ্যক্রম, শিক্ষণ পদ্ধতি, শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক, নারীশিক্ষা, সীমাবদ্ধতা এবং বিভিন্ন শাসকের পৃষ্ঠপোষকতা সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরব, যা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য अत्यंत গুরুত্বপূর্ণ।
ইসলামিক শিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্য
মধ্যযুগীয় ভারতে প্রচলিত ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থার কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিল, যা একে পূর্ববর্তী শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে পৃথক করেছিল।
ধর্মকেন্দ্রিকতা: এই শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি ছিল ইসলাম ধর্ম। কোরান, হাদিস, শরিয়ত ইত্যাদি ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ ও তার ব্যাখ্যাই ছিল শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। সমস্ত জ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্যই ছিল ইসলামিক জীবনদর্শনকে বোঝা এবং অনুসরণ করা।
রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা: সুলতান ও মুঘল সম্রাটরা ছিলেন এই শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তাঁরা মকতব ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, শিক্ষকদের বেতন প্রদান এবং ছাত্রদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করতেন। জ্ঞানচর্চাকে তাঁরা নিজেদের মর্যাদা ও শাসনের স্থায়িত্বের প্রতীক হিসেবে দেখতেন।
রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অভাব: যদিও শাসকরা এর পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, কিন্তু শিক্ষার বিষয়বস্তু বা পাঠ্যক্রমের উপর কঠোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সাধারণত, বিশিষ্ট আলেম বা শিক্ষাবিদরা মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করতেন।
বিনামূল্যে শিক্ষা: অধিকাংশ মকতব ও মাদ্রাসায় শিক্ষা ছিল অবৈতনিক। অনেক ক্ষেত্রে ছাত্রদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করা হতো। ধনী ব্যক্তি এবং শাসকরা এর ব্যয়ভার বহন করতেন।
শিক্ষার মাধ্যম: শিক্ষার প্রধান মাধ্যম ছিল ফারসি ও আরবি। ফারসি ছিল রাজদরবারের ভাষা এবং প্রশাসনিক কাজের মাধ্যম, তাই এর গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। আরবি ছিল ধর্মীয় গ্রন্থ কোরানের ভাষা, তাই ধর্মীয় উচ্চশিক্ষার জন্য এটি অপরিহার্য ছিল।
লৌকিক ও পারলৌকিক জ্ঞানের সমন্বয়: শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ধর্মীয় হলেও, রাষ্ট্র পরিচালনার প্রয়োজনে ইতিহাস, ভূগোল, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা এবং तर्कশাস্ত্রের মতো লৌকিক বিষয়গুলিও পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ইসলামিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
মধ্যযুগীয় ভারতে ইসলামিক শিক্ষার সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল, যা নিম্নরূপ:
জ্ঞানার্জন: ইসলামের দৃষ্টিতে জ্ঞানার্জন একটি পবিত্র দায়িত্ব। তাই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মীয় ও জাগতিক উভয় প্রকার জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল শিক্ষার প্রাথমিক লক্ষ্য।
ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার: ভারতে মুসলিম শাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় করার জন্য ইসলাম ধর্মের আদর্শ ও দর্শন জনগণের মধ্যে প্রচার করা ছিল এই শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। শিক্ষিত ব্যক্তিরা ধর্ম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।
ইসলামিক সংস্কৃতির বিস্তার: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে ইসলামিক সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, শিষ্টাচার এবং জীবনযাত্রার প্রসার ঘটানো হতো। এর ফলে স্থাপত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা ও সাহিত্যে এক নতুন ধারার জন্ম হয়।
চরিত্র গঠন: শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইসলামিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলা এবং তাদের চরিত্রকে ধর্মীয় অনুশাসনের ভিত্তিতে গঠন করা শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল। সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও ধার্মিকতাকে গুরুত্ব দেওয়া হতো।
রাষ্ট্রের জন্য কর্মচারী তৈরি: বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য দক্ষ प्रशासक, বিচারক (কাজী), কর সংগ্রাহক এবং অন্যান্য কর্মচারীর প্রয়োজন ছিল। মাদ্রাসাগুলি এই ধরনের কর্মচারী তৈরির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
বস্তুগত সমৃদ্ধি অর্জন: শিক্ষা শুধুমাত্র পারলৌকিক মুক্তির জন্য নয়, জাগতিক জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ এবং বস্তুগত সমৃদ্ধি অর্জনের একটি মাধ্যম হিসেবেও বিবেচিত হতো।
শিক্ষাব্যবস্থার স্তরবিন্যাস ও প্রতিষ্ঠান
ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থা দুটি প্রধান স্তরে বিভক্ত ছিল: প্রাথমিক স্তর ও উচ্চশিক্ষা স্তর।
ক) মকতব (Maktab) – প্রাথমিক শিক্ষা:
‘মকতব’ শব্দটি আরবি ‘কুতুব’ শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ‘লেখা’। সুতরাং, মকতব ছিল লেখার স্থান বা প্রাথমিক বিদ্যালয়।
এগুলি সাধারণত মসজিদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকত এবং ইমাম বা কোনো শিক্ষিত ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত হতো।
শিশুর বয়স চার বছর, চার মাস, চার দিন হলে তাকে মকতবে পাঠানো হতো। শিক্ষার সূচনা হতো একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, যা ‘বিসমিল্লাহ-খানি’ (Bismillah-Khani) নামে পরিচিত ছিল। এই অনুষ্ঠানে শিশু পবিত্র কোরানের কিছু আয়াত পাঠ করত।
পাঠ্যক্রম: মকতবের পাঠ্যক্রমে মূলত কোরানের আয়াত মুখস্থ করা, পড়া, লেখা এবং সাধারণ গণিত (3 R’s – Reading, Writing, Arithmetic) শেখানো হতো। শেখ সাদির ‘গুলিস্তাঁ’ ও ‘বোস্তাঁ’-এর মতো নীতিকথামূলক গ্রন্থও পড়ানো হতো।
শিক্ষণ পদ্ধতি: শিক্ষণ পদ্ধতি ছিল মূলত মৌখিক এবং স্মৃতি-নির্ভর। শিক্ষকরা পাঠ্য বিষয়গুলি আবৃত্তি করতেন এবং ছাত্ররা তা শুনে মুখস্থ করত।
খ) মাদ্রাসা (Madrasa) – উচ্চশিক্ষা:
‘মাদ্রাসা’ শব্দটি আরবি ‘দরস’ শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ‘ভাষণ দেওয়া’। মাদ্রাসা ছিল উচ্চশিক্ষা লাভের কেন্দ্র।
এগুলি সাধারণত সুলতান, আমির-ওমরাহ এবং ধনী ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত হতো। মাদ্রাসাগুলিতে গ্রন্থাগার এবং ছাত্রাবাসের সুব্যবস্থা ছিল।
দিল্লি, আগ্রা, লাহোর, জৌনপুর, বিদর প্রভৃতি শহর উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
পাঠ্যক্রম: মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম ছিল ব্যাপক এবং দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত:
মানকূলাত (Manqulat): ধর্মীয় বা ঐতিহ্যবাহী বিজ্ঞান। এর মধ্যে ছিল কোরান, হাদিস, তাফসির (কোরানের ব্যাখ্যা), ফিকাহ (ইসলামিক আইনশাস্ত্র) এবং সুফিবাদ।
মাকূলাত (Maqulat): যুক্তিনির্ভর বা জাগতিক বিজ্ঞান। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল তর্কশাস্ত্র (মানতিক), দর্শন (ফালসাফা), গণিত (রিয়াজি), জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা (নুজুম), চিকিৎসাবিদ্যা (তিব্ব), ইতিহাস (তারিখ), ভূগোল এবং সাহিত্য।
বিখ্যাত মাদ্রাসা: ফিরোজ শাহ তুঘলক প্রতিষ্ঠিত ‘মাদ্রাসা-ই-ফিরোজশাহী’, হুমায়ুনের প্রতিষ্ঠিত দিল্লির মাদ্রাসা, আকবরের ফতেপুর সিক্রির মাদ্রাসা এবং শাহজাহানের ‘দার-উল-বাকা’ উল্লেখযোগ্য।
পাঠ্যক্রমের বিস্তারিত বিবরণ
মধ্যযুগের ইসলামিক শিক্ষার পাঠ্যক্রম সময়ের সাথে এবং শাসকের নীতির উপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হয়েছে।
প্রাথমিক স্তর (মকতব): এখানে প্রধানত ধর্মীয় শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হতো। শিশুরা আরবি বর্ণমালা শিখত এবং কোরান পাঠে দক্ষ হতো। ফারসি ভাষার প্রাথমিক জ্ঞান এবং হিসাবরক্ষার জন্য সাধারণ গণিত শেখানো হতো।
উচ্চশিক্ষা স্তর (মাদ্রাসা): সুলতানি যুগে পাঠ্যক্রম মূলত ধর্মীয় বিষয় কেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু ফিরোজ শাহ তুঘলকের সময় থেকে জাগতিক বিষয়ের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। সিকান্দার লোদির আমলে তর্কশাস্ত্র ও দর্শনের চর্চা বৃদ্ধি পায়।
আকবরের সংস্কার: মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে পাঠ্যক্রমে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে। তিনি ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জাগতিক বিষয় যেমন—কৃষি, জ্যামিতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইতিহাসকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার উপর জোর দেন। তিনি হিন্দু ছাত্রদের জন্য সংস্কৃত ও দর্শন পড়ার ব্যবস্থাও করেন। তাঁর আমলে একটি অনুবাদ বিভাগ খোলা হয়েছিল, যেখানে রামায়ণ, মহাভারত, অথর্ববেদ প্রভৃতি সংস্কৃত গ্রন্থ ফারসিতে অনূদিত হয়।
অন্যান্য বিষয়: ক্যালিগ্রাফি বা হস্তলিপিবিদ্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হতো। সামরিক শিক্ষার জন্য অস্ত্রচালনা, অশ্বারোহণ এবং রণকৌশল শেখানো হতো।
শিক্ষণ পদ্ধতি
ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছু নির্দিষ্ট শিক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো।
মৌখিক ও স্মৃতি-নির্ভর পদ্ধতি: মুদ্রণযন্ত্রের অভাবের কারণে শিক্ষাদান ছিল মূলত মৌখিক। শিক্ষক বলতেন এবং ছাত্ররা শুনে তা মুখস্থ করত। কোরান ও অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ মুখস্থ করাকে অত্যন্ত পুণ্যের কাজ বলে মনে করা হতো।
বক্তৃতা ও আলোচনা পদ্ধতি: মাদ্রাসার উচ্চ স্তরে শিক্ষক কোনো বিষয়ের উপর বিস্তারিত বক্তৃতা দিতেন। এরপর ছাত্ররা সেই বিষয়ের উপর প্রশ্ন করতে এবং আলোচনায় অংশ নিতে পারত।
মনিটরিয়াল প্রথা: এই ব্যবস্থায় উচ্চ শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রদের নিম্ন শ্রেণীর ছাত্রদের পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হতো। এটি শিক্ষকদের কাজের চাপ কমাতে এবং ছাত্রদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশে সহায়তা করত।
স্ব-অধ্যয়ন: ছাত্রদের গ্রন্থাগারে গিয়ে নিজে থেকে পড়াশোনা করার জন্য উৎসাহিত করা হতো। মাদ্রাসার বিশাল গ্রন্থাগারগুলি জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র ছিল।
ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ: কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্রে হাতে-কলমে শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হতো। শিক্ষার্থীরা ওস্তাদের অধীনে থেকে বিভিন্ন শিল্পকর্ম শিখত।
শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক এবং মূল্যায়ন
শিক্ষক: শিক্ষককে ‘উস্তাদ’ বা ‘মৌলবি’ বলা হতো। সমাজে তাঁরা অত্যন্ত সম্মানীয় ব্যক্তি ছিলেন। শিক্ষকরা কেবল জ্ঞান দান করতেন না, ছাত্রদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক হিসেবেও কাজ করতেন।
ছাত্র: ছাত্রকে ‘শাগির্দ’ বলা হতো। ছাত্রদের অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন করতে হতো এবং শিক্ষকের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রদর্শন করতে হতো। শিক্ষকের সেবা করা ছাত্রদের অন্যতম কর্তব্য বলে মনে করা হতো।
সম্পর্ক: শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের মতো গভীর ও স্নেহপূর্ণ।
মূল্যায়ন ও উপাধি: কোনো নির্দিষ্ট সময় অন্তর আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা ব্যবস্থা ছিল না। শিক্ষকই ছিলেন ছাত্রদের মূল্যায়নের একমাত্র কর্তৃপক্ষ। কোনো ছাত্র একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করলে শিক্ষক তাকে সেই বিষয়ে সমাপ্তি ঘোষণা করতেন।
উপাধি: শিক্ষা সমাপ্তির পর ছাত্রদের বিভিন্ন উপাধি দেওয়া হতো। যেমন:
ধর্মশাস্ত্রে পারদর্শী ব্যক্তিকে বলা হতো ‘আলিম’ (Alim)।
তর্কশাস্ত্র ও দর্শনে পারদর্শী ব্যক্তিকে বলা হতো ‘ফাজিল’ (Fazil)।
সাহিত্যে পারদর্শী ব্যক্তিকে বলা হতো ‘কামিল’ (Kamil)।
নারীশিক্ষা
মধ্যযুগে নারীশিক্ষার প্রসার ছিল অত্যন্ত সীমিত। পর্দা প্রথার কঠোরতার কারণে সাধারণ পরিবারের মেয়েদের শিক্ষা লাভের সুযোগ প্রায় ছিল না বললেই চলে। তবে, সুলতান ও সম্রাটদের পরিবারের এবং অভিজাত শ্রেণীর মহিলারা গৃহে থেকে শিক্ষালাভের সুযোগ পেতেন। তাঁদের জন্য ‘জেনানা’ (Zenana) বা অন্তঃপুরে শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল।
উল্লেখযোগ্য বিদুষী নারী: সুলতানা রাজিয়া, হুমায়ুনের বোন গুলবদন বেগম (যিনি ‘হুমায়ুননামা’ রচনা করেন), নুরজাহান, শাহজাহানের কন্যা জাহানারা এবং আওরঙ্গজেবের কন্যা জেব-উন-নিসা ছিলেন উচ্চশিক্ষিতা। তাঁরা সাহিত্য, কবিতা ও শিল্পকলায় পারদর্শী ছিলেন।
বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা
ইসলামিক শাসকরা বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে এবং বিলাস-ব্যসনের সামগ্রী তৈরির জন্য বিভিন্ন ধরনের কারিগরি শিক্ষার প্রচলন ছিল।
শাসকদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ‘কারখানা’ (Karkhana) নামক কর্মশালা গড়ে তোলা হয়েছিল, যেখানে দক্ষ কারিগররা বিভিন্ন শিল্পকর্মের প্রশিক্ষণ দিতেন।
হস্তশিল্প, বস্ত্রবয়ন, স্থাপত্য, চিত্রকলা, রত্নশিল্প, অস্ত্র নির্মাণ প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। মুঘল মিনিয়েচার পেইন্টিং এবং তাজমহলের মতো স্থাপত্য এই উন্নত কারিগরি শিক্ষারই ফল।
ইসলামিক শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকগণ
বিভিন্ন মুসলিম শাসক শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
সুলতানি যুগ:
কুতুবুদ্দিন আইবক এবং ইলতুৎমিস দিল্লিতে একাধিক মাদ্রাসা স্থাপন করেন।
ফিরোজ শাহ তুঘলক ছিলেন সুলতানি যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষানুরাগী শাসক। তিনি প্রায় ৩০টি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন এবং ‘মাদ্রাসা-ই-ফিরোজশাহী’ ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তিনি विद्वानদের বিপুল অনুদান দিতেন।
সিকান্দার লোদি আগ্রায় একটি শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং ফারসি সাহিত্যের চর্চায় উৎসাহ দেন।
মুঘল যুগ:
হুমায়ুন দিল্লিতে একটি গ্রন্থাগার স্থাপন করেছিলেন।
আকবর ছিলেন মুঘল যুগের শ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। তিনি ফতেপুর সিক্রিকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত করেন। তাঁর উদার নীতির ফলে হিন্দু ও মুসলিম ছাত্রদের একসাথে পড়ার সুযোগ তৈরি হয়।
জাহাঙ্গীর ও শাহজাহান উভয়েই শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং বহু মাদ্রাসা নির্মাণ ও সংস্কার করেন।
আওরঙ্গজেব গোঁড়া মুসলিম হলেও, তিনি বহু মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং দরিদ্র ছাত্রদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। দিল্লির বিখ্যাত ‘মাদ্রাসা-ই-রহিমিয়া’ তাঁর আমলেই প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইসলামিক শিক্ষার সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটি
বহু অবদান থাকা সত্ত্বেও মধ্যযুগীয় ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থার কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল:
অতিরিক্ত ধর্মীয় গোঁড়ামি: শিক্ষার মূল লক্ষ্য ধর্ম প্রচার হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবাদ অবহেলিত হয়েছে। আওরঙ্গজেবের আমলে এই রক্ষণশীলতা বৃদ্ধি পায়।
দেশীয় ভাষা ও জ্ঞানের অবহেলা: শিক্ষার মাধ্যম আরবি ও ফারসি হওয়ায় সাধারণ মানুষের ভাষা, যেমন— বাংলা, হিন্দি প্রভৃতিতে জ্ঞানচর্চার সুযোগ ছিল সীমিত। প্রাচীন ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞানও অনেকাংশে অবহেলিত হয়।
গণশিক্ষার অভাব: শিক্ষা মূলত শহর এবং অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। গ্রামীণ জনগণের জন্য শিক্ষা লাভের সুযোগ প্রায় ছিল না।
নারীশিক্ষার প্রতি উদাসীনতা: পর্দা প্রথার কারণে নারীশিক্ষা ব্যাপকভাবে অবহেলিত হয়েছে।
মুখস্থ-নির্ভরতা: শিক্ষার পদ্ধতি মূলত স্মৃতি-নির্ভর হওয়ায় ছাত্রদের মধ্যে মৌলিক চিন্তা বা সৃজনশীলতার বিকাশ ব্যাহত হয়েছে।
অস্থায়িত্ব: শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতার উপর নির্ভরশীল ছিল। কোনো শাসকের উদাসীনতায় বা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি সংকটের মুখে পড়ত।
উপসংহার
মধ্যযুগীয় ভারতে ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সময়কার রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন। একদিকে যেমন এই ব্যবস্থা ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রসারে এবং একটি দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো তৈরিতে সফল হয়েছিল, তেমনই অন্যদিকে এর কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল। এই শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেই ভারতে ফারসি সাহিত্যের বিকাশ ঘটে এবং হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ে উর্দু ভাষার মতো একটি নতুন ভাষার জন্ম হয়। মুঘল স্থাপত্য ও চিত্রকলা আজও তার শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষ্য বহন করে।
তবে, গণশিক্ষা ও নারীশিক্ষার অবহেলা এবং দেশীয় জ্ঞানচর্চার প্রতি উদাসীনতা ছিল এর প্রধান ত্রুটি। তা সত্ত্বেও, মধ্যযুগের ভারতের সামাজিক ও বৌদ্ধিক ইতিহাস নির্মাণে ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থার অবদান অনস্বীকার্য। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে, এই ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠান, পরিভাষা, পৃষ্ঠপোষক এবং তাদের অবদানগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নমুনা এমসিকিউ (MCQ) ও উত্তর
মধ্যযুগে ইসলামিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কী নামে পরিচিত ছিল? (A) মাদ্রাসা (B) দরগাহ (C) মকতব (D) খানকাহ
ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুর বিদ্যাচর্চা শুরুর অনুষ্ঠানকে কী বলা হতো? (A) উপনয়ন (B) হাতেখড়ি (C) বিসমিল্লাহ-খানি (D) পব্বজ্জা
মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমে যুক্তিনির্ভর বা জাগতিক বিষয়গুলিকে কী বলা হতো? (A) মানকূলাত (B) মাকূলাত (C) ফিকাহ (D) তাফসির
সুলতানি যুগের কোন শাসক শিক্ষা বিস্তারের জন্য সর্বাধিক পরিচিত? (A) আলাউদ্দিন খলজি (B) গিয়াসউদ্দিন বলবন (C) ফিরোজ শাহ তুঘলক (D) ইলতুৎমিস
মুঘল সম্রাট আকবর কোন শহরে ‘ইবাদত খানা’ প্রতিষ্ঠা করেন? (A) দিল্লি (B) আগ্রা (C) লাহোর (D) ফতেপুর সিক্রি
মধ্যযুগে শিক্ষার প্রধান মাধ্যম কোন দুটি ভাষা ছিল? (A) সংস্কৃত ও পালি (B) আরবি ও ফারসি (C) তুর্কি ও ফারসি (D) উর্দু ও হিন্দি
‘হুমায়ুননামা’ কে রচনা করেন? (A) জাহানারা বেগম (B) নুরজাহান (C) গুলবদন বেগম (D) জেব-উন-নিসা
ইসলামিক শিক্ষণ পদ্ধতিতে মেধাবী ছাত্রদের দ্বারা নিম্ন শ্রেণীর ছাত্রদের পড়ানোর প্রথাকে কী বলা হয়? (A) স্ব-অধ্যয়ন (B) আলোচনা পদ্ধতি (C) বক্তৃতা পদ্ধতি (D) মনিটরিয়াল প্রথা
দিল্লির বিখ্যাত ‘মাদ্রাসা-ই-রহিমিয়া’ কোন মুঘল সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিল? (A) আকবর (B) শাহজাহান (C) জাহাঙ্গীর (D) আওরঙ্গজেব
উত্তর:
(C) মকতব
(C) বিসমিল্লাহ-খানি
(B) মাকূলাত
(C) ফিরোজ শাহ তুঘলক
(D) ফতেপুর সিক্রি
(C) আলিম
(B) আরবি ও ফারসি
(C) গুলবদন বেগম
(D) মনিটরিয়াল প্রথা
(D) আওরঙ্গজেব
সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১: ‘মকতব’ এবং ‘মাদ্রাসা’-র মধ্যে মূল পার্থক্য কী?
উত্তর: ‘মকতব’ ছিল ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাথমিক স্তর, যেখানে শিশুদের পড়া, লেখা, এবং কোরানের প্রাথমিক জ্ঞান দেওয়া হতো। অন্যদিকে, ‘মাদ্রাসা’ ছিল উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র, যেখানে ধর্মশাস্ত্র, আইন, দর্শন, বিজ্ঞান এবং সাহিত্যের মতো বিষয় বিস্তারিতভাবে পড়ানো হতো।
প্রশ্ন ২: ‘বিসমিল্লাহ-খানি’ অনুষ্ঠানটি কী?
উত্তর: ‘বিসমিল্লাহ-খানি’ হলো ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি শিশুর বিদ্যাচর্চা শুরুর আনুষ্ঠানিক প্রথা। শিশুর বয়স চার বছর, চার মাস, চার দিন পূর্ণ হলে এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাকে পবিত্র কোরানের কিছু আয়াত পাঠ করিয়ে মকতবে তার পড়াশোনা শুরু করা হতো।
প্রশ্ন ৩: মুঘল সম্রাট আকবর শিক্ষা ব্যবস্থায় কী কী গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এনেছিলেন?
উত্তর: মুঘল সম্রাট আকবর পাঠ্যক্রমে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জাগতিক বিষয় যেমন—গণিত, জ্যামিতি, ইতিহাস, এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি হিন্দু ছাত্রদের জন্য সংস্কৃত পড়ার ব্যবস্থা করেন এবং বিভিন্ন ভারতীয় গ্রন্থ ফারসিতে অনুবাদের জন্য একটি অনুবাদ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন ৪: মধ্যযুগের ইসলামিক শিক্ষায় ব্যবহৃত দুটি প্রধান শিক্ষণ পদ্ধতি উল্লেখ করুন।
উত্তর: মধ্যযুগের ইসলামিক শিক্ষায় ব্যবহৃত দুটি প্রধান পদ্ধতি হলো:
মৌখিক ও স্মৃতি-নির্ভর পদ্ধতি: যেখানে শিক্ষক পাঠ্য বিষয় আবৃত্তি করতেন এবং ছাত্ররা তা শুনে মুখস্থ করত।
মনিটরিয়াল প্রথা: যেখানে উচ্চ শ্রেণীর মেধাবী ছাত্ররা নিম্ন শ্রেণীর ছাত্রদের পড়ানোর দায়িত্ব পেত।
উত্তর: মধ্যযুগে পর্দা প্রথার কারণে নারীশিক্ষা মূলত রাজপরিবার এবং অভিজাত শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ নারীদের শিক্ষা লাভের সুযোগ প্রায় ছিল না। একজন উচ্চশিক্ষিতা মুঘল নারী হলেন গুলবদন বেগম, যিনি ‘হুমায়ুননামা’ গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন।
MCQ Practice Set
মধ্যযুগীয় ভারতে ইসলামিক শিক্ষা – মক টেস্ট
মধ্যযুগীয় ভারতে ইসলামিক শিক্ষা
মক টেস্ট
নির্দেশাবলী:
মোট প্রশ্ন সংখ্যা: ২০
সময়সীমা: ২০ মিনিট
প্রতিটি প্রশ্নের জন্য একটি সঠিক উত্তর নির্বাচন করুন।
আপনি ‘Next’ এবং ‘Previous’ বোতাম ব্যবহার করে প্রশ্ন পরিবর্তন করতে পারেন।
সময় শেষ হওয়ার আগে ‘Finish Test’ বোতামে ক্লিক করুন।