Marxism, Teacher and Teaching Method || মার্ক্সবাদ , শিক্ষণ পদ্ধতি ও শিক্ষকের ভূমিকা
ভূমিকা
শিক্ষা নিছক তথ্য বা জ্ঞানের আদান-প্রদান নয়, বরং এটি একটি গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। যেকোনো সমাজের শিক্ষাব্যবস্থা সেই সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি, রাজনৈতিক কাঠামো এবং প্রভাবশালী ভাবাদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) এবং তাঁর সহযোগী ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫) সরাসরি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে विस्तृत গ্রন্থ রচনা না করলেও, তাঁদের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism), দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism) এবং শ্রেণি-সংগ্রামের তত্ত্বের আলোকে শিক্ষাকে বিশ্লেষণ করার একটি শক্তিশালী কাঠামো তাঁরা প্রদান করেছেন। মার্ক্সবাদী দর্শন অনুযায়ী, শিক্ষা হলো সমাজের উপরিকাঠামোর (Superstructure) একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি (Base) অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থার দ্বারা নির্ধারিত হয়। পুঁজিবাদী সমাজে শিক্ষা মূলত শাসকশ্রেণি অর্থাৎ বুর্জোয়াদের স্বার্থ রক্ষা করে এবং তাদের ভাবাদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
এই প্রবন্ধে আমরা মার্ক্সবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা, মার্ক্সবাদী শিক্ষাদর্শনের মূল নীতিসমূহ, তার ভিত্তিতে প্রস্তাবিত শিক্ষণ পদ্ধতি এবং একজন শিক্ষকের বৈপ্লবিক ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। এই আলোচনা শুধুমাত্র একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নয়, বরং শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তনের সম্ভাবনাকেও অন্বেষণ করার একটি প্রয়াস।
১. পুঁজিবাদী শিক্ষাব্যবস্থার মার্ক্সবাদী সমালোচনা: ভাবাদর্শগত রাষ্ট্রযন্ত্র
মার্ক্সবাদ অনুসারে, কোনো সমাজের চরিত্র বোঝা যায় তার উৎপাদন পদ্ধতির মাধ্যমে। পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা থাকে মুষ্টিমেয় বুর্জোয়া শ্রেণির হাতে, আর বৃহত্তর শ্রমিক শ্রেণি বা প্রলেতারিয়েত তাদের শ্রম বিক্রি করে জীবনধারণ করে। এই অর্থনৈতিক ভিত্তি বা ‘বেস’-এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে আইন, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং শিক্ষার মতো উপরিকাঠামোগত প্রতিষ্ঠানগুলো। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল কাজ হলো অর্থনৈতিক ভিত্তিকে টিকিয়ে রাখা এবং শাসক শ্রেণির আধিপত্যকে স্বাভাবিক ও চিরস্থায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
ফরাসি মার্ক্সবাদী দার্শনিক লুই আলথুসার (Louis Althusser) এই ধারণাটিকে আরও স্পষ্ট করেছেন তাঁর ‘ভাবাদর্শগত রাষ্ট্রযন্ত্র’ (Ideological State Apparatuses – ISA) তত্ত্বের মাধ্যমে। আলথুসার রাষ্ট্রযন্ত্রকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন:
ক) দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র (Repressive State Apparatus – RSA): যেমন—পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিচারব্যবস্থা, যা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে শাসন টিকিয়ে রাখে।
খ) ভাবাদর্শগত রাষ্ট্রযন্ত্র (Ideological State Apparatus – ISA): যেমন—শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, যা বলপ্রয়োগের পরিবর্তে ভাবাদর্শ প্রচারের মাধ্যমে মানুষের সম্মতি আদায় করে এবং শাসক শ্রেণির নিয়ন্ত্রণকে বৈধতা দেয়।
আলথুসারের মতে, আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো সবচেয়ে শক্তিশালী ISA। বিদ্যালয়গুলো আপাতদৃষ্টিতে নিরপেক্ষ জ্ঞানের স্থান মনে হলেও, বাস্তবে তারা অত্যন্ত সুকৌশলে পুঁজিবাদী ভাবাদর্শকে নতুন প্রজন্মের মনে প্রোথিত করে। এই প্রক্রিয়াটি কয়েকটি উপায়ে সম্পন্ন হয়:
- পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে: পাঠ্যক্রমে এমন বিষয়বস্তু নির্বাচন করা হয় যা পুঁজিবাদী মূল্যবোধকে মহিমান্বিত করে। যেমন—ইতিহাসে রাজ-রাজড়াদের কাহিনী বা শিল্পপতিদের সাফল্যের গাঁথা পড়ানো হয়, কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রাম বা শোষণের ইতিহাসকে চেপে যাওয়া হয়। প্রতিযোগিতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং মুনাফা অর্জনকে সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
- ‘লুকানো পাঠ্যক্রম’ (Hidden Curriculum): আনুষ্ঠানিক পাঠ্যক্রমের বাইরেও বিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কার্যকলাপ, নিয়মকানুন এবং শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কিছু অলিখিত শিক্ষা লাভ করে। যেমন—কর্তৃপক্ষের প্রতি অন্ধ আনুগত্য, সময়ানুবর্তিতা (যা কারখানার শ্রমিকের জন্য জরুরি), প্রতিযোগিতা এবং (individualism)। এই লুকানো পাঠ্যক্রম শিক্ষার্থীদের পুঁজিবাদী সমাজের যোগ্য, অনুগত ও বিচ্ছিন্ন নাগরিকে পরিণত করে।
- শ্রেণি বিভাজনের পুনঃউৎপাদন: শিক্ষাব্যবস্থা মেধার নামে আদতে শ্রেণি বিভাজনকে আরও দৃঢ় করে। উচ্চবিত্তের সন্তানরা উন্নত মানের শিক্ষা ও সুযোগ-সুবিধা পেয়ে ভালো ফলাফল করে এবং সমাজের সুবিধাজনক অবস্থানে নিজেদের জায়গা করে নেয়। অন্যদিকে, শ্রমিক বা নিম্নবিত্তের ছেলেমেয়েরা দুর্বল পরিকাঠামো ও প্রতিকূল পরিবেশের কারণে পিছিয়ে পড়ে এবং পরিণামে তাদের পূর্বপুরুষদের মতোই শ্রমিক শ্রেণিতেই থেকে যেতে বাধ্য হয়। এইভাবে শিক্ষা সামাজিক সচলতার মাধ্যম না হয়ে, শ্রেণি কাঠামোকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে টিকিয়ে রাখার একটি যন্ত্রে পরিণত হয়।
- বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation): মার্ক্সের বিচ্ছিন্নতাবাদের তত্ত্বটি শিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক। পুঁজিবাদী শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা তাদের ‘শ্রম’ অর্থাৎ পড়াশোনার ফল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জ্ঞানকে শুধুমাত্র পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ার বা চাকরির বাজারে নিজেকে বিক্রি করার উপায় হিসেবে দেখা হয়। ফলে জ্ঞানের সঙ্গে শিক্ষার্থীর আত্মিক যোগ তৈরি হয় না। শিক্ষার্থীরা একে অপরের থেকে প্রতিযোগিতার কারণে এবং সামগ্রিক সমাজ জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
২. মার্ক্সবাদী শিক্ষাদর্শনের মূল নীতিসমূহ
পুঁজিবাদী শিক্ষার এই সমালোচনার ভিত্তিতেই মার্ক্সবাদীরা এক বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা নির্মাণ করেন, যার মূল লক্ষ্য হলো শোষণমূলক ব্যবস্থার অবসান ঘটানো এবং এক শ্রেণিহীন, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এই শিক্ষাদর্শনের কয়েকটি মূল নীতি হলো:
- দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism) ও শিক্ষা: মার্ক্সবাদী জ্ঞানতত্ত্ব দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই দর্শন অনুযায়ী, জগৎ স্থির নয়, পরিবর্তনশীল। প্রতিটি বস্তুর বা ধারণার (থিসিস) মধ্যেই তার বিপরীতধর্মী শক্তি (অ্যান্টিথিসিস) নিহিত থাকে এবং এই দুইয়ের দ্বন্দ্বের ফলেই একটি নতুন ও উন্নততর অবস্থার (সিন্থেসিস) জন্ম হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে এর প্রয়োগ হলো—জ্ঞানকে চূড়ান্ত বা ধ্রুব সত্য হিসেবে উপস্থাপন না করে, তাকে একটি বিকাশমান প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা। শ্রেণিকক্ষে মুক্ত বিতর্ক, প্রশ্ন এবং সমালোচনামূলক আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করবে এবং নতুন জ্ঞানে উপনীত হবে।
- প্র্যাক্সিস (Praxis): তত্ত্ব ও প্রয়োগের সমন্বয়: এটি মার্ক্সবাদী শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্রীয় ধারণা। ‘প্র্যাক্সিস’ বলতে বোঝায় তত্ত্ব (Theory) এবং প্রয়োগের (Practice) অবিচ্ছেদ্য মেলবন্ধন। মার্ক্সের বিখ্যাত উক্তি, “দার্শনিকেরা এতদিন কেবল বিশ্বকে নানাভাবে ব্যাখ্যাই করেছেন, কিন্তু আসল কাজ হলো তাকে পরিবর্তন করা।” (The philosophers have only interpreted the world, in various ways; the point is to change it.)। মার্ক্সবাদী শিক্ষা শুধুমাত্র পুঁথিগত জ্ঞানে সীমাবদ্ধ থাকে না। শিক্ষার্থীরা যা শেখে, তা সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত করে এবং সেই জ্ঞানকে সমাজ পরিবর্তনের কাজে ব্যবহার করে। শিক্ষা হলো সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার।
- বহুমুখী কারিগরি শিক্ষা (Polytechnical Education): মার্ক্স মানসিক শ্রম (Mental Labour) এবং কায়িক শ্রমের (Manual Labour) মধ্যেকার বিভাজনকে পুঁজিবাদী সমাজের একটি অন্যতম প্রধান শোষণমূলক কৌশল হিসেবে দেখেছেন। এই বিভাজন দূর করার জন্য তিনি ‘পলিটেকনিক্যাল এডুকেশন’ বা বহুমুখী কারিগরি শিক্ষার প্রস্তাব দেন। এর অর্থ হলো, শিক্ষার্থীদের একদিকে যেমন বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাসের মতো তাত্ত্বিক জ্ঞান দেওয়া হবে, তেমনই অন্যদিকে তাদের উৎপাদনমূলক কায়িক শ্রমের সঙ্গেও পরিচয় করানো হবে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা ‘পূর্ণাঙ্গ মানুষ’ (Complete Human Being) হিসেবে গড়ে উঠবে, যারা তত্ত্ব ও প্রয়োগ উভয় ক্ষেত্রেই দক্ষ হবে এবং শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে।
- শ্রেণি–চেতনার বিকাশ (Development of Class Consciousness): মার্ক্সবাদী শিক্ষার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীর মধ্যে শ্রেণি-চেতনার উন্মেষ ঘটানো। অর্থাৎ, শিক্ষার্থীকে তার নিজের শ্রেণি-অবস্থান, সমাজের শোষণমূলক চরিত্র এবং ঐতিহাসিক পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হিসেবে শ্রমিক শ্রেণির ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। এই চেতনা তাকে ব্যক্তিগত সাফল্যের ঊর্ধ্বে উঠে সমষ্টিগত মুক্তির সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করবে।
- যৌথ ও সহযোগিতামূলক শিক্ষা (Collective and Collaborative Learning): পুঁজিবাদী শিক্ষা যেখানে প্রতিযোগিতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে উৎসাহিত করে, সেখানে মার্ক্সবাদী শিক্ষা যৌথতা ও সহযোগিতার উপর জোর দেয়। শিক্ষার্থীরা একে অপরের প্রতিযোগী নয়, সহযোদ্ধা। সোভিয়েত শিক্ষাবিদ আন্তন মাকারেঙ্কো (Anton Makarenko) তাঁর শিক্ষাচিন্তায় যৌথ জীবন ও যৌথ শ্রমের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তাঁর মতে, যৌথ পরিবেশে কাজ করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ ও সংহতি গড়ে ওঠে।
৩. মার্ক্সবাদী শিক্ষণ পদ্ধতি
উপরোক্ত নীতিগুলির উপর ভিত্তি করে মার্ক্সবাদী শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে কিছু নির্দিষ্ট শিক্ষণ পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন। এগুলি কোনো নির্দিষ্ট ফর্মুলা নয়, বরং একটি দর্শন দ্বারা পরিচালিত কৌশল।
- সমস্যামূলক শিক্ষণ পদ্ধতি (Problem-Posing Method): ব্রাজিলীয় মার্ক্সবাদী শিক্ষাচিন্তক পাওলো ফ্রেয়ার (Paulo Freire) এই পদ্ধতির একজন প্রধান প্রবক্তা। তিনি প্রচলিত শিক্ষাকে ‘ব্যাংকিং শিক্ষা’ (Banking Concept of Education) বলে অভিহিত করেছেন, যেখানে শিক্ষক জ্ঞান ‘জমা’ করেন এবং শিক্ষার্থীরা তা নিষ্ক্রিয়ভাবে ‘গ্রহণ’ করে। এর বিপরীতে তিনি ‘সমস্যামূলক শিক্ষণ পদ্ধতি’র কথা বলেন। এই পদ্ধতিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই সহ-অনুসন্ধানকারী হিসেবে কাজ করেন। তাঁরা শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে উঠে আসা বাস্তব সমস্যা (যেমন—দারিদ্র্য, বেকারত্ব, লিঙ্গবৈষম্য, পরিবেশ দূষণ) নিয়ে শ্রেণিকক্ষে আলোচনা শুরু করেন। এই সমস্যাগুলিকে ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করা হয় এবং এর মূল কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা জগৎকে пассивভাবে গ্রহণ না করে, তাকে প্রশ্ন করতে শেখে এবং পরিবর্তনের জন্য সক্রিয় হয়।
- দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতি (Dialectical Method): শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক একটি প্রভাবশালী বা প্রচলিত ধারণা (থিসিস) উপস্থাপন করতে পারেন। এরপর তিনি শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করবেন সেই ধারণার সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা বা বিপরীত মত (অ্যান্টিথিসিস) খুঁজে বের করার জন্য। এই দুই মতের মধ্যেকার বিতর্ক ও আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মিলে একটি অধিকতর সঙ্গত ও সামগ্রিক সিদ্ধান্তে (সিন্থেসিস) উপনীত হবেন। এই পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের সমালোচনামূলক চিন্তার বিকাশ ঘটায় এবং কোনো কিছুকেই বিনা প্রশ্নে মেনে না নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করে।
- পাঠ্যক্রমকে উৎপাদন ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত করা: মার্ক্সবাদী শিক্ষণ পদ্ধতিতে পাঠ্যবিষয়কে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হিসেবে দেখা হয় না। ইতিহাস পড়ানোর সময় শুধুমাত্র রাজারাজড়ার কাহিনী নয়, বরং বিভিন্ন সময়ে ঘটা কৃষক বিদ্রোহ, শ্রমিক আন্দোলন এবং শ্রেণি-সংগ্রামের ইতিহাসকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিজ্ঞান পাঠের সময় প্রযুক্তির সামাজিক প্রভাব এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তার অপব্যবহার নিয়ে আলোচনা করা হয়। অর্থনীতি পড়ানোর সময় শুধুমাত্র বাজারের নিয়মকানুন নয়, বরং শ্রমের শোষণ এবং পুঁজির সঞ্চয়ন প্রক্রিয়াকে উন্মোচন করা হয়। এইভাবে প্রতিটি বিষয়কে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
- সমালোচনামূলক পাঠ (Critical Reading): শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় কীভাবে যেকোনো টেক্সট বা বয়ানকে সমালোচনার চোখে পড়তে হয়। কোনো লেখা পড়ার সময় প্রশ্ন করতে শেখানো হয়—এই লেখাটি কে লিখেছেন? তাঁর শ্রেণি-অবস্থান কী? এই লেখার মাধ্যমে কার স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে? কোন সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে এবং কোন সত্যকে আড়াল করা হচ্ছে? এই পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভাবাদর্শকে চেনার ও তাকে বিনির্মাণ (deconstruct) করার ক্ষমতা তৈরি করে।
৪. মার্ক্সবাদী কাঠামোয় শিক্ষকের ভূমিকা: বৈপ্লবিক বুদ্ধিজীবী
মার্ক্সবাদী কাঠামোয় শিক্ষকের ভূমিকা প্রচলিত ‘জ্ঞানদাতা’ বা ‘নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক’-এর ভূমিকা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। শিক্ষক এখানে একজন রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মী। ইতালীয় মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদ আন্তোনিও গ্রামশি (Antonio Gramsci)-র ‘অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল’ (Organic Intellectual) বা ‘জৈব বুদ্ধিজীবী’-র ধারণার সঙ্গে মার্ক্সবাদী শিক্ষকের ভূমিকার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
- নিরপেক্ষতার মুখোশ উন্মোচন: মার্ক্সবাদী শিক্ষক প্রথমত এই সত্যটি অনুধাবন করেন যে, শিক্ষা বা শিক্ষক কেউই নিরপেক্ষ নন। হয় তিনি সচেতন বা অচেতনভাবে স্থিতাবস্থা (status quo) বজায় রাখতে সাহায্য করছেন, অথবা তিনি তাকে পরিবর্তনের জন্য কাজ করছেন। তাই তিনি নিরপেক্ষতার ভান না করে, সচেতনভাবে শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষ অবলম্বন করেন।
- সামাজিক পরিবর্তনের কারিগর (Agent of Social Change): শিক্ষকের কাজ শ্রেণিকক্ষের চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি একজন সক্রিয় সামাজিক কর্মী। তিনি স্থানীয় মানুষের সমস্যা নিয়ে ভাববেন, সামাজিক আন্দোলনে অংশ নেবেন এবং শিক্ষার্থীদেরও সামাজিক কাজে যুক্ত হতে উৎসাহিত করবেন। তাঁর লক্ষ্য হলো বিদ্যালয়কে সামাজিক পরিবর্তনের একটি কেন্দ্রে পরিণত করা।
- সহায়ক ও সহ–শিক্ষার্থী (Facilitator and Co-learner): মার্ক্সবাদী শিক্ষক একজন স্বৈরাচারী শাসক নন, বরং তিনি একজন সহায়ক বা ফ্যাসিলিটেটর। তিনি শিক্ষার্থীদের উপর জ্ঞান চাপিয়ে দেন না, বরং তাদের সঙ্গে মিলে জ্ঞান অন্বেষণ করেন। তিনি শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতাকে সম্মান করেন এবং তাদের কাছ থেকেও শেখার জন্য প্রস্তুত থাকেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হয় পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও কমরেডশিপের।
- সমালোচনামূলক চেতনার উন্মেষক: শিক্ষকের প্রধান কাজ হলো পাওলো ফ্রেয়ারের ভাষায় ‘কনসিয়েন্টাইজেশন’ (Conscientização) বা চেতনার উন্মেষ ঘটানো। তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন এক সমালোচনামূলক দৃষ্টি তৈরি করে দেন, যার মাধ্যমে তারা সমাজের ভেতরের শোষণ ও অসাম্যকে দেখতে পায় এবং তা দূর করার জন্য সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তিনি প্রশ্ন করতে শেখান, ভাবতে শেখান এবং স্বপ্ন দেখতে শেখান—এক নতুন, শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন।
সমালোচনা ও প্রাসঙ্গিকতা
মার্ক্সবাদী শিক্ষাদর্শনের বিরুদ্ধে কিছু সমালোচনাও উত্থাপিত হয়। প্রধান সমালোচনা হলো, সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনের মতো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে মার্ক্সবাদী শিক্ষা প্রায়শই রাষ্ট্রীয় প্রচারণার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সেখানে পুঁজিবাদী ভাবাদর্শের পরিবর্তে একটি নতুন রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সমালোচনামূলক চিন্তাকে একইভাবে খর্ব করেছে। দ্বিতীয়ত, একটি পুরোপুরি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে থেকে একজন বা মুষ্টিমেয় শিক্ষক কতটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারেন, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। প্রাতিষ্ঠানিক চাপ, নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম এবং পরীক্ষার বোঝা তাঁদের হাত-পা বেঁধে রাখে।
এত সমালোচনা সত্ত্বেও, বর্তমান নয়া-উদারবাদী (Neoliberal) বিশ্বে মার্ক্সবাদী শিক্ষাচিন্তার প্রাসঙ্গিকতা কমে যায়নি, বরং বেড়েছে। যখন শিক্ষাকে ক্রমশ একটি পণ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে, যখন বৈষম্য আকাশচুম্বী এবং যখন মানুষের চেয়ে মুনাফাকে বড় করে দেখা হচ্ছে, তখন মার্ক্সবাদের শিক্ষাদর্শন আমাদের একটি শক্তিশালী সমালোচনামূলক হাতিয়ার জোগান দেয়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, শিক্ষা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার গড়ার সিঁড়ি নয়, এটি সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মুক্তির এক শক্তিশালী মাধ্যম।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, মার্ক্সবাদের আলোকে শিক্ষণ পদ্ধতি ও শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গভীর ও বিপ্লবী। এটি শিক্ষাকে শুধুমাত্র জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়া হিসেবে না দেখে, দেখে এক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে। মার্ক্সবাদী শিক্ষাপদ্ধতি—যেমন সমস্যামূলক শিক্ষণ, দ্বন্দ্বমূলক আলোচনা এবং তত্ত্ব ও প্রয়োগের মেলবন্ধন—শিক্ষার্থীদের নিষ্ক্রিয় গ্রাহক থেকে সক্রিয়, চিন্তাশীল ও পরিবর্তনকামী নাগরিকে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করে। এই কাঠামোয় শিক্ষক কোনো বেতনভুক কর্মচারী নন, তিনি একজন বৈপ্লবিক বুদ্ধিজীবী, যাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো শ্রেণি-চেতনা জাগ্রত করার মাধ্যমে এক শোষণমুক্ত, সাম্যবাদী সমাজ গঠনের পথ প্রশস্ত করা। যদিও এই আদর্শকে বাস্তবে রূপায়ণ করা অত্যন্ত কঠিন ও সংগ্রামসাপেক্ষ, তবুও শিক্ষার মাধ্যমে এক উন্নততর ও ন্যায়পরায়ণ পৃথিবী গড়ার যে স্বপ্ন মার্ক্সবাদ দেখায়, তা আজও বিশ্বের কোটি কোটি শিক্ষাবিদ ও সামাজিক কর্মীকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলেছে।