প্রাচীন ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা: ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ধারার একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ

প্রাচীন ভারত শুধুমাত্র তার আধ্যাত্মিক দর্শন, রাজনৈতিক উত্থান-পতন বা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্যই পরিচিত ছিল না, বরং তার সুসংগঠিত ও উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যও ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এই শিক্ষা ব্যবস্থা কোনো আকস্মিক সৃষ্টি ছিল না, বরং তা ছিল যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত জ্ঞান, জীবনদর্শন এবং সামাজিক প্রয়োজনের এক সম্মিলিত প্রতিফলন। প্রাচীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে মূলত দুটি প্রধান ধারায় বিভক্ত করা যায়— বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা (Brahmanical Education System) এবং বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা (Buddhist Education System)

এই দুটি ব্যবস্থা সমসাময়িক হলেও তাদের দর্শন, লক্ষ্য, সংগঠন এবং পদ্ধতির মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান ছিল। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি ছিল বেদ এবং তার মূল লক্ষ্য ছিল ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ—এই চতুর্বর্গ লাভের মাধ্যমে ব্যক্তির আধ্যাত্মিক মুক্তি। অন্যদিকে, বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার উৎস ছিলেন গৌতম বুদ্ধের দর্শন এবং এর প্রধান লক্ষ্য ছিল অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করে জাগতিক দুঃখের অবসান ঘটিয়ে নির্বাণ লাভ করা।

এই প্রবন্ধে আমরা প্রাচীন ভারতের এই দুটি প্রধান শিক্ষা ধারার মূল বৈশিষ্ট্য, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, পাঠক্রম, শিক্ষাদান পদ্ধতি, গুরু-শিষ্য সম্পর্ক, শিক্ষাকেন্দ্র এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তির মতো বিষয়গুলিকে বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করব এবং পরিশেষে একটি তুলনামূলক পর্যালোচনার মাধ্যমে তাদের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলিকে তুলে ধরব।


প্রথম পর্ব: বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা (Brahmanical Education System)

ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম শিক্ষা ব্যবস্থাগুলির মধ্যে অন্যতম। এর মূল ভিত্তি ছিল বেদ—ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ এবং অথর্ববেদ। এই শিক্ষা মূলত গুরুকেন্দ্রিক এবং আবাসিক প্রকৃতির ছিল, যা গুরুকুল প্রথা নামে পরিচিত।

১. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (Aims and Objectives):

ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার লক্ষ্য ছিল শুধুমাত্র জাগতিক জ্ঞান অর্জন নয়, বরং ব্যক্তির সামগ্রিক বিকাশ সাধন করা, যা তাকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক—উভয় জগতেই সফল করতে পারে। এর প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল নিম্নরূপ:

  • মোক্ষ বা আধ্যাত্মিক মুক্তি (Spiritual Liberation): ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল ‘মোক্ষ’ বা মুক্তি লাভ। এই দর্শন অনুযায়ী, মানব জীবন জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবদ্ধ এবং এই চক্র থেকে মুক্তি পাওয়াই হলো জীবনের পরম উদ্দেশ্য। আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান লাভের মাধ্যমেই এই মুক্তি সম্ভব। শিক্ষা ছিল সেই আত্মজ্ঞান অর্জনের সোপান।
  • চরিত্র গঠন (Character Formation): নৈতিকতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা গঠন ছিল এই শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মসংযম, শৃঙ্খলা, বিনয়, সত্যবাদিতা, গুরুভক্তি এবং কর্তব্যানিষ্ঠার মতো গুণাবলীর বিকাশ ঘটানো হতো। চরিত্রবান নাগরিক ছাড়া একটি সুস্থ সমাজ গঠন অসম্ভব বলে মনে করা হতো।
  • সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও সঞ্চালন (Preservation and Transmission of Culture): ব্রাহ্মণ্য যুগে মুদ্রণযন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল না। তাই বৈদিক সাহিত্য, দর্শন এবং ঐতিহ্যকে मौखिक বা শ্রুতির মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সঞ্চালিত করা শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল। গুরুরা তাঁদের শিষ্যদের বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্র মুখস্থ করিয়ে দিতেন, যা সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করত।
  • সামাজিক ও নাগরিক দায়িত্ব পালন (Fulfillment of Social and Civic Duties): শিক্ষা ব্যক্তিকে শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক মুক্তির জন্যই প্রস্তুত করত না, বরং তাকে একজন দায়িত্বশীল সামাজিক জীব হিসেবেও গড়ে তুলত। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং দেব-ঋষিদের প্রতি তার যে কর্তব্য (পঞ্চমহাযজ্ঞ), সে সম্পর্কে তাকে সচেতন করা হতো।
  • ব্যক্তিত্বের সার্বিক বিকাশ (Holistic Personality Development): এই শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীর শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক—এই সকল দিকের সুষম বিকাশ। শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যার উপর জোর না দিয়ে আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা এবং আত্মনির্ভরশীলতা বিকাশের দিকেও নজর দেওয়া হতো।

২. পাঠক্রম (Curriculum):

ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার পাঠক্রম ছিল অত্যন্ত ব্যাপক ও সুসংগঠিত। একে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হতো:

  • পরা বিদ্যা (Spiritual Knowledge): এটি ছিল উচ্চতর বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান, যার লক্ষ্য ছিল ব্রহ্মজ্ঞান বা মোক্ষ লাভ। এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি ছিল:
    • চতুর্বেদ: ঋক্, সাম, যজুঃ, অথর্ব।
    • বেদাঙ্গ (ছয়টি): শিক্ষা (উচ্চারণ), কল্প (অনুষ্ঠান), ব্যাকরণ, নিরুক্ত (শব্দতত্ত্ব), ছন্দ এবং জ্যোতিষ।
    • উপনিষদ ও আরণ্যক: বেদের দর্শন ও আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা।
    • দর্শনশাস্ত্র: ষড়দর্শন (সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা, বেদান্ত)।
  • অপর বিদ্যা (Worldly/Secular Knowledge): এটি ছিল জাগতিক বা व्यावहारिक জ্ঞান, যা ব্যক্তিকে জীবনধারণ এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনে সহায়তা করত। এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি ছিল:
    • ভাষা ও সাহিত্য: সংস্কৃত ভাষা ও ব্যাকরণ (যেমন পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’)।
    • যুক্তিবিদ্যা (তর্কশাস্ত্র) ও গণিত (জ্যামিতি, বীজগণিত)।
    • চিকিৎসাশাস্ত্র (আয়ুর্বেদ): চরক ও সুশ্রুতের মতো ঋষিদের জ্ঞান।
    • ধনুর্বিদ্যা ও সামরিক বিজ্ঞান: মূলত ক্ষত্রিয়দের জন্য।
    • শিল্পকলা, সঙ্গীত ও ভাস্কর্য।
    • বাণিজ্য, কৃষি ও পশুপালন।

৩. শিক্ষাদান পদ্ধতি (Methods of Teaching):

ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং মনস্তাত্ত্বিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।

  • গুরুকুল প্রথা: শিক্ষার্থীরা গুরুর গৃহে বা আশ্রমে তাঁর পরিবারের সদস্যের মতো বসবাস করত। এই আবাসিক ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যাই লাভ করত না, বরং গুরুর জীবনযাপন ও আদর্শ প্রত্যক্ষ করে নিজেদের চরিত্র গঠন করত।
  • মৌখিক পদ্ধতি: সমস্ত জ্ঞান মূলত মৌখিকভাবে প্রদান করা হতো। গুরু মন্ত্র বা সূত্র উচ্চারণ করতেন এবং শিষ্যরা তা শুনে মুখস্থ করত। স্মৃতিশক্তির উপর অত্যন্ত জোর দেওয়া হতো।
  • শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন: এটি ছিল জ্ঞানার্জনের তিনটি প্রধান স্তর।
    • শ্রবণ: গুরু যা বলছেন তা গভীর মনোযোগ সহকারে শোনা।
    • মনন: শ্রুত বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা, যুক্তি-তর্ক দিয়ে তার অর্থ বোঝার চেষ্টা করা।
    • নিদিধ্যাসন: মননের মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞানকে ধ্যানের মাধ্যমে আত্মস্থ করা বা তার সাক্ষাৎকার করা। এটিই ছিল জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তর।
  • প্রশ্নোত্তর ও তর্ক-বিতর্ক পদ্ধতি: শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসাকে উৎসাহিত করা হতো এবং বিভিন্ন বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক বা শাস্ত্রার্থের আয়োজন করা হতো।
  • নায়ক পদ্ধতি (Monitorial System): উচ্চ শ্রেণীর মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিম্ন শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হতো। এতে তাদের নিজেদের জ্ঞান আরও দৃঢ় হতো এবং গুরুরও শিক্ষাদানের ভার লাঘব হতো।

৪. গুরু-শিষ্য সম্পর্ক (Teacher-Student Relationship):

ব্রাহ্মণ্য শিক্ষায় গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত পবিত্র ও নিবিড়, যা পিতা-পুত্রের সম্পর্কের সমতুল্য। গুরু শুধুমাত্র শিক্ষাদাতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন শিষ্যের আধ্যাত্মিক পিতা ও পথপ্রদর্শক। শিষ্যের ভরণপোষণ, স্বাস্থ্য এবং চারিত্রিক বিকাশের সমস্ত দায়িত্ব গুরু গ্রহণ করতেন। বিনিময়ে শিষ্য গুরুকে পরম শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁর সেবা করতেন। শিক্ষাশেষে শিষ্য গুরুদক্ষিণা হিসেবে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী গুরুকে কিছু প্রদান করতেন।

৫. আনুষ্ঠানিকতা (Ceremonies):

  • উপনয়ন: এটি ছিল শিক্ষা শুরুর আনুষ্ঠানিকতা, যা সাধারণত ৮ থেকে ১২ বছর বয়সের মধ্যে সম্পন্ন হতো। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বালককে গুরুর কাছে নিয়ে যাওয়া হতো এবং সে ‘ব্রহ্মচারী’ হিসেবে নতুন জীবন শুরু করত। এটি তার দ্বিতীয় জন্ম (‘দ্বিজ’) বলে বিবেচিত হতো।
  • সমাবর্তন: গুরুকুলে শিক্ষা সমাপ্তির পর এই অনুষ্ঠান হতো। এর মাধ্যমে ব্রহ্মচারী গার্হস্থ্য জীবনে প্রবেশের অনুমতি পেত। এই অনুষ্ঠানে গুরু শিষ্যকে শেষ উপদেশ দিতেন, যা ‘সমাবর্তন ভাষণ’ নামে পরিচিত।

৬. নারী শিক্ষা (Women’s Education):

প্রারম্ভিক বৈদিক যুগে (ঋগ্বেদের সময়) নারী শিক্ষার যথেষ্ট প্রচলন ছিল। লোপামুদ্রা, ঘোষা, অপালা, গার্গী, মৈত্রেয়ীর মতো বিদুষী নারীরা এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁরা পুরুষদের সঙ্গে শাস্ত্রার্থে অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগে এবং সূত্র ও স্মৃতিশাস্ত্রের সময়ে নারী শিক্ষার অবনতি ঘটে। তাদের উপনয়ন বন্ধ হয়ে যায় এবং শিক্ষা মূলত গার্হস্থ্য কাজেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

৭. সমালোচনা (Criticism):

ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার বহু ইতিবাচক দিক থাকলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল:

  • এটি ছিল মূলত উচ্চ তিন বর্ণের (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য) জন্য সীমাবদ্ধ। শূদ্রদের শিক্ষার অধিকার ছিল না, যা সমাজে বিভেদ তৈরি করেছিল।
  • শিক্ষার মাধ্যম সংস্কৃত হওয়ায় এটি সাধারণ মানুষের ভাষা থেকে দূরে সরে গিয়েছিল।
  • অতিরিক্ত স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভরশীলতা অনেক ক্ষেত্রে মৌলিক চিন্তাকে ব্যাহত করত।
  • পরবর্তী যুগে এটি অত্যন্ত কঠোর ও আনুষ্ঠানিক হয়ে পড়েছিল।

দ্বিতীয় পর্ব: বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা (Buddhist Education System)

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ব্রাহ্মণ্য সমাজের কঠোরতা, জাতিভেদ প্রথা এবং যাগযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে বৌদ্ধধর্মের উত্থান ঘটে। এই ধর্মের দর্শনের উপর ভিত্তি করে এক নতুন, সুসংগঠিত এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার জন্ম হয়।

১. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (Aims and Objectives):

বৌদ্ধ শিক্ষার মূল দর্শন ছিল দুঃখের অবসান এবং আত্মবিকাশ। এর প্রধান উদ্দেশ্যগুলি হলো:

  • নির্বাণ লাভ (Attainment of Nirvana): এটি ছিল বৌদ্ধ শিক্ষার সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত লক্ষ্য। বুদ্ধের মতে, জীবন দুঃখময় এবং তৃষ্ণাই এই দুঃখের কারণ। অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করে এই তৃষ্ণার অবসান ঘটিয়ে জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি বা ‘নির্বাণ’ লাভ করা সম্ভব। শিক্ষাই ছিল এই পথ প্রদর্শক।
  • চরিত্র গঠন: আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের অন্যতম উপাদান ছিল সম্যক চরিত্র। বৌদ্ধ শিক্ষায় অহিংসা, করুণা, মৈত্রী, সততা, সংযম এবং ত্যাগের মতো মানবিক গুণাবলীর উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হতো।
  • বৌদ্ধধর্মের প্রচার (Propagation of Buddhism): শিক্ষিত ভিক্ষুরা দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করে বুদ্ধের বাণী ও দর্শন প্রচার করতেন। শিক্ষা ছিল ধর্ম প্রচারের একটি শক্তিশালী মাধ্যম।
  • সামাজিক ও গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ: বৌদ্ধ শিক্ষা ছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত। এটি সমাজে সাম্য ও গণতান্ত্রিক চেতনার প্রসারে সহায়তা করেছিল।
  • ব্যক্তিত্বের বিকাশ: এই শিক্ষাও ব্যক্তির সামগ্রিক বিকাশে বিশ্বাসী ছিল, তবে এখানে আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি নৈতিক ও সামাজিক বিকাশের উপর বেশি জোর দেওয়া হতো।

২. পাঠক্রম (Curriculum):

বৌদ্ধ শিক্ষার পাঠক্রম ছিল মূলত ধর্মকেন্দ্রিক, তবে জাগতিক বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

  • ধর্মীয় পাঠক্রম: এর প্রধান অংশ ছিল ‘ত্রিপিটক’— বিনয় পিটক (সংঘের নিয়ম), সূত্র পিটক (বুদ্ধের উপদেশ) এবং অভিধর্ম পিটক (দর্শন)।
  • লৌকিক পাঠক্রম: ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের যুক্তিবিদ্যা (হেতুবিদ্যা), চিকিৎসাশাস্ত্র, ব্যাকরণ, শিল্পকলা এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষাও দেওয়া হতো। তবে ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার মতো জাগতিক বিষয়গুলির উপর ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। নালন্দার মতো মহাবিহারে বিভিন্ন বিষয়ের পঠন-পাঠন চলত।

৩. শিক্ষাদান পদ্ধতি (Methods of Teaching):

বৌদ্ধ শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল প্রাতিষ্ঠানিক এবং সংঘবদ্ধ।

  • প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা: শিক্ষা মূলত বিহার ও মহাবিহার নামক প্রতিষ্ঠানে প্রদান করা হতো। এগুলি ছিল সুসংগঠিত, আবাসিক শিক্ষাকেন্দ্র, যা আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য।
  • বক্তৃতা ও আলোচনা: আচার্যরা একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন এবং তারপর শিক্ষার্থীরা সেই বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও বিতর্ক করত।
  • সম্মেলন: বিভিন্ন বিহার থেকে পণ্ডিতরা এসে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও জ্ঞান বিনিময় করতেন।
  • পর্যটন ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা: শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন পবিত্র স্থান ভ্রমণ করে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সাথে মিশে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করত।
  • পালি ভাষার ব্যবহার: শিক্ষার মাধ্যম ছিল পালি, যা ছিল তৎকালীন সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা। ফলে শিক্ষা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল।

৪. আচার্য-শিষ্য সম্পর্ক (Teacher-Student Relationship):

বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষককে ‘আচার্য’ বা ‘উপাধ্যায়’ বলা হতো। এখানেও গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক শ্রদ্ধার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, কিন্তু এটি গুরুকুলের মতো ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ছিল না। সম্পর্কটি ছিল প্রাতিষ্ঠানিক এবং সংঘের নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শিষ্যরা আচার্যের তত্ত্বাবধানে থাকত এবং তাঁর সেবা করত।

৫. আনুষ্ঠানিকতা (Ceremonies):

  • প্রব্রজ্যা (Pabbajja): এটি ছিল বৌদ্ধ শিক্ষাজীবনে প্রবেশের প্রথম ধাপ, যা সাধারণত ৮ বছর বয়সে হতো। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থী সংসার ত্যাগ করে সংঘে প্রবেশ করত এবং ‘শ্রামণ’ বা ‘শ্রমণ’ হিসেবে পরিচিত হতো। তাকে ত্রি-রত্নের (বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ) শরণ নিতে হতো এবং দশটি শীল বা নিয়ম পালনের শপথ নিতে হতো।
  • উপসম্পদা (Upasampada): কমপক্ষে ১২ বছর শ্রামণ হিসেবে শিক্ষালাভের পর (সাধারণত ২০ বছর বয়সে) ‘উপসম্পদা’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাকে পূর্ণাঙ্গ ‘ভিক্ষু’ হিসেবে সংঘে গ্রহণ করা হতো। এর জন্য দশজন বরিষ্ঠ ভিক্ষুর অনুমতি প্রয়োজন হতো।

৬. শিক্ষাকেন্দ্র (Centers of Learning):

বৌদ্ধ শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র ছিল বিহারমহাবিহার। এগুলি ছিল বিশাল এবং সুসংগঠিত প্রতিষ্ঠান, যা রাজা ও শ্রেষ্ঠীদের দানে পরিচালিত হতো। কিছু বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র হলো:

  • নালন্দা মহাবিহার: এটি ছিল প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে ভারত ছাড়াও চীন, তিব্বত, কোরিয়া ও মধ্য এশিয়া থেকে ছাত্ররা পড়তে আসত। এখানে বিশাল গ্রন্থাগার ছিল (‘ধর্মগঞ্জ’) এবং প্রবেশিকা পরীক্ষা অত্যন্ত কঠিন ছিল, যা ‘দ্বার-পণ্ডিত’ নিতেন।
  • তক্ষশীলা: এটি বৌদ্ধ যুগের আগেও শিক্ষার কেন্দ্র ছিল, কিন্তু বৌদ্ধ যুগে এর খ্যাতি আরও বৃদ্ধি পায়। এখানে চিকিৎসাশাস্ত্র ও অন্যান্য জাগতিক বিদ্যার উপর জোর দেওয়া হতো।
  • বিক্রমশীলা, অদন্তপুরী, সোমপুরী: এগুলি ছিল পাল যুগে বাংলায় এবং বিহারে গড়ে ওঠা বিখ্যাত বৌদ্ধ মহাবিহার।

৭. নারী শিক্ষা (Women’s Education):

প্রথমদিকে বুদ্ধ নারীদের সংঘে প্রবেশের বিষয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁর বিমাতা গৌতমী এবং শিষ্য আনন্দের অনুরোধে তিনি ‘ভিক্ষুণী সংঘ’ প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেন। এর ফলে নারীদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। বহু নারী ভিক্ষুণী হয়ে শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক চর্চায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন।

৮. সমালোচনা (Criticism):

  • এই শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল মূলত সন্ন্যাসী বা ভিক্ষু তৈরির জন্য, সাধারণ গৃহস্থদের জন্য উপযুক্ত ছিল না।
  • পাঠক্রম ছিল অতিরিক্ত ধর্মকেন্দ্রিক, যার ফলে জাগতিক বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।
  • এই ব্যবস্থা মূলত রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার উপর নির্ভরশীল ছিল। তাই রাজাদের সমর্থনের অভাবে পরবর্তীকালে এই শিক্ষাকেন্দ্রগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে।

তৃতীয় পর্ব: ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ শিক্ষার তুলনামূলক আলোচনা

প্রাচীন ভারতের এই দুটি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে কিছু সাদৃশ্য থাকলেও বৈসাদৃশ্যই ছিল প্রধান।

সাদৃশ্য (Similarities):

  • চূড়ান্ত লক্ষ্য: উভয় ব্যবস্থারই চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্তি—ব্রাহ্মণ্য মতে ‘মোক্ষ’ এবং বৌদ্ধ মতে ‘নির্বাণ’।
  • চরিত্র গঠন: দুটি ব্যবস্থাই শিক্ষার্থীর নৈতিক ও চারিত্রিক বিকাশের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিত।
  • শৃঙ্খলা: আত্মসংযম ও কঠোর শৃঙ্খলা উভয় ক্ষেত্রেই অপরিহার্য ছিল।
  • গুরু/আচার্যের স্থান: শিক্ষককে উভয় ব্যবস্থাতেই সর্বোচ্চ সম্মান ও শ্রদ্ধার আসনে বসানো হতো।
  • আবাসিক শিক্ষা: গুরুকুল এবং বিহার—দুটিই ছিল আবাসিক প্রকৃতির।

বৈসাদৃশ্য (Differences):

বৈশিষ্ট্যব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থাবৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা
দর্শনবেদ, উপনিষদ, আত্ম ও ব্রহ্মের ধারণা।ত্রিপিটক, অনাত্মবাদ, কর্মফল ও নির্বাণ।
সংগঠনবিকেন্দ্রীভূত, গুরুকেন্দ্রিক (গুরুকুল)।কেন্দ্রীভূত, প্রাতিষ্ঠানিক (বিহার, সংঘ)।
প্রবেশাধিকারবর্ণভিত্তিক, মূলত উচ্চ তিন বর্ণের জন্য।জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত।
শিক্ষার মাধ্যমমূলত সংস্কৃত (পণ্ডিতদের ভাষা)।মূলত পালি (সাধারণ মানুষের ভাষা)।
পাঠক্রমের প্রকৃতিআধ্যাত্মিক (পরা) ও জাগতিক (অপর) বিদ্যার সুষম সমন্বয়।মূলত ধর্মকেন্দ্রিক, জাগতিক বিদ্যা ছিল গৌণ।
গুরু-শিষ্য সম্পর্কব্যক্তিগত ও পারিবারিক (পিতা-পুত্রের ন্যায়)।প্রাতিষ্ঠানিক ও সংঘের নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
নারী শিক্ষাপ্রারম্ভিক বৈদিক যুগে উন্নত, পরে অবনতি।প্রাতিষ্ঠানিক (ভিক্ষুণী সংঘ), তুলনামূলকভাবে বেশি উদার।
অর্থায়নগুরুর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা, ভিক্ষা, রাজকীয় ও শ্রেষ্ঠীদের দান।মূলত রাজা ও শ্রেষ্ঠীদের বিপুল ভূমিদান ও অর্থ সাহায্যের উপর নির্ভরশীল।
শিক্ষার প্রকৃতিব্যক্তিকেন্দ্রিক ও আধ্যাত্মিক।সংঘবদ্ধ, সামাজিক ও নৈতিক।
চূড়ান্ত পরিণতিগৃহস্থ জীবনে প্রত্যাবর্তন (সমাবর্তন) বা সন্ন্যাস।আজীবন ভিক্ষু জীবনযাপন (উপসম্পদা)।

ব্রাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধ—এই দুটি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রাচীন ভারতের জ্ঞানচর্চার দুটি ভিন্ন কিন্তু শক্তিশালী ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করে। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা যেখানে ব্যক্তির আধ্যাত্মিক মুক্তি এবং বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণের উপর জোর দিয়েছিল, সেখানে বৌদ্ধ শিক্ষা সামাজিক সাম্য, নৈতিকতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠনের মাধ্যমে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল।

ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থা ছিল রক্ষণশীল এবং অভিজাতকেন্দ্রিক, কিন্তু তা ভারতীয় দর্শন, ব্যাকরণ ও বিজ্ঞানের ভিত্তি রচনা করেছিল। অন্যদিকে, বৌদ্ধ ব্যবস্থা ছিল উদার, গণতান্ত্রিক এবং আন্তর্জাতিক। নালন্দার মতো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে এটি ভারতকে বিশ্বের দরবারে জ্ঞানের পীঠস্থানে পরিণত করেছিল।

উভয় ব্যবস্থাই তাদের সময় ও দর্শনের নিরিখে সফল ছিল। তাদের পদ্ধতিগত পার্থক্য সত্ত্বেও, দুটি ধারাই চরিত্র গঠন, আত্মসংযম এবং জ্ঞানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার মতো শাশ্বত মূল্যবোধকে তুলে ধরেছিল। এই দুই মহান শিক্ষা ধারার সম্মিলিত ঐতিহ্যই প্রাচীন ভারতের গৌরবময় জ্ঞানচর্চার ভিত্তি, যা আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *