Principles of Curriculum Construction [পাঠক্রম নির্মাণের মূলনীতি]

          শিক্ষা একটি জাতির প্রগতি ও উন্নয়নের মূল ভিত্তি। আর এই শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র হলো তার পাঠক্রম। ‘পাঠক্রম’ বা ‘Curriculum’ শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘Currere’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ‘দৌড়ের পথ’ (Race Course)। সংকীর্ণ অর্থে পাঠক্রম বলতে কেবল কয়েকটি নির্দিষ্ট বিষয়ের তাত্ত্বিক জ্ঞান বা পাঠ্যসূচিকে বোঝানো হয়। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাদর্শনে পাঠক্রমের ধারণা অনেক ব্যাপক ও গভীর। এটি হলো সেই সামগ্রিক অভিজ্ঞতা, যা শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের ভেতরে ও বাইরে শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে অর্জন করে এবং যার মাধ্যমে তাদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ (শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, প্রাক্ষোভিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক) সম্ভব হয়।

ভারতবর্ষ একটি বিশাল, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং বহু ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দেশ। এই দেশের সাংবিধানিক মূল্যবোধ, সামাজিক চাহিদা এবং অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য একটি সুচিন্তিত ও কার্যকরী পাঠক্রম নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি। পাঠক্রম নির্মাণের কাজটি কোনো বিচ্ছিন্ন বা আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং এটি একটি ধারাবাহিক, বিজ্ঞানসম্মত এবং দর্শন-নির্ভর প্রক্রিয়া। এর পেছনে থাকে কিছু সুনির্দিষ্ট নীতি বা আদর্শ, যা পাঠক্রমকে প্রাসঙ্গিক, জীবন্ত এবং উদ্দেশ্যমুখী করে তোলে। এই প্রবন্ধে আমরা ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পাঠক্রম নির্মাণের সেইসব মূলনীতিগুলি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।

পাঠক্রম নির্মাণের মূলনীতিসমূহ (Principles of Curriculum Construction)

একটি আদর্শ পাঠক্রম রচনার জন্য শিক্ষাবিদগণ কিছু সর্বজনস্বীকৃত নীতির কথা উল্লেখ করেছেন। ভারতীয় প্রেক্ষাপটে এই নীতিগুলির প্রয়োগ ও গুরুত্ব অপরিসীম। প্রধান নীতিগুলি নিম্নরূপ:

১. শিশুকেন্দ্রিকতার নীতি (Principle of Child-Centricity)

আধুনিক শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি হলো শিশুকেন্দ্রিকতা। প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা ছিল শিক্ষককেন্দ্রিক বা বিষয়কেন্দ্রিক, যেখানে শিশুর আগ্রহ, ক্ষমতা, চাহিদা বা মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাকে গুরুত্ব দেওয়া হতো না। কিন্তু আধুনিক মনোবিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, শিক্ষা তখনই সফল হয় যখন তা শিশুর স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, বয়স, সামর্থ্য এবং ব্যক্তিগত বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।

  • শিশুর চাহিদা ও আগ্রহ: পাঠক্রম এমনভাবে রচনা করতে হবে যা শিশুর জন্মগত কৌতূহলকে জাগিয়ে তোলে এবং তার জিজ্ঞাসাকে সম্মান করে। খেলাধুলা, গল্প বলা, ছবি আঁকা, গান গাওয়া ইত্যাদি বিষয়কে প্রাথমিক স্তরে অন্তর্ভুক্ত করা এই নীতিরই প্রতিফলন।
  • বয়স ও পরিণমন: প্রতিটি বয়সের শিশুদের শেখার ক্ষমতা ও মানসিক গঠন ভিন্ন হয়। তাই কোন বয়সে কোন বিষয়টি শেখানো হবে, তা মনস্তৈাত্ত্বিকভাবে স্থির করতে হয়। যেমন, বিমূর্ত ধারণা (abstract concepts) উচ্চ প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তরের আগে ভালোভাবে শেখানো সম্ভব নয়।
  • ব্যক্তিগত বৈষম্য: একই শ্রেণিকক্ষে থাকা সমস্ত ছাত্রছাত্রীর মেধা, আগ্রহ এবং শেখার গতি একরকম হয় না। তাই পাঠক্রমে এমন ব্যবস্থা থাকা উচিত যাতে মেধাবী, সাধারণ এবং ধীরগতিসম্পন্ন—সকল প্রকার শিক্ষার্থীই নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী শিখতে পারে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের (Children with Special Needs) জন্যও পাঠক্রমে উপযুক্ত ব্যবস্থা রাখা এই নীতির অন্তর্গত।

ভারতীয় প্রেক্ষাপটে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, ঋষি অরবিন্দ প্রমুখ শিক্ষাবিদ শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। NCF (National Curriculum Framework) 2005 এবং NEP (National Education Policy) 2020-তে শিশুকেন্দ্রিকতাকে পাঠক্রম নির্মাণের প্রধান স্তম্ভ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

২. কর্মকেন্দ্রিকতার নীতি (Principle of Activity-Based Learning)

“Learning by doing” বা কাজের মাধ্যমে শেখা—এই নীতিটি আধুনিক পাঠক্রমের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। শিশুরা স্বভাবতই সক্রিয় এবং তারা নিষ্ক্রিয়ভাবে জ্ঞান গ্রহণ করার চেয়ে সক্রিয়ভাবে কোনো কাজে অংশ নিয়ে শিখতে বেশি পছন্দ করে। কর্মকেন্দ্রিক পাঠক্রম শিক্ষার্থীদের কেবল পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে আবদ্ধ না রেখে বাস্তব অভিজ্ঞতার সুযোগ করে দেয়।

  • হাতে-কলমে শিক্ষা: বিজ্ঞান ক্লাসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, ভূগোলে মানচিত্র তৈরি করা, কর্মশিক্ষায় কোনো জিনিস তৈরি করা ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান অনেক বেশি স্থায়ী ও অর্থবহ হয়।
  • প্রকল্প পদ্ধতি (Project Method): শিক্ষার্থীদের কোনো একটি বাস্তব সমস্যা সমাধানে বা কোনো বিষয় অনুসন্ধানে একটি প্রকল্পে নিযুক্ত করা যেতে পারে। এটি তাদের মধ্যে সহযোগিতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটায়।
  • শ্রমের মর্যাদা: মহাত্মা গান্ধীর বুনিয়াদী শিক্ষা (Basic Education) এই নীতির উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিল, যেখানে কোনো একটি হস্তশিল্পকে কেন্দ্র করে সমস্ত বিষয় পড়ানোর কথা বলা হয়েছিল। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শ্রমের প্রতি মর্যাদা এবং আত্মনির্ভরশীলতা গড়ে ওঠে।

NEP 2020-তে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই শিক্ষার্থীদের বৃত্তিমূলক শিক্ষার (Vocational Education) সঙ্গে পরিচয় করানোর কথা বলা হয়েছে, যা এই কর্মকেন্দ্রিক নীতিরই একটি আধুনিক রূপ।

৩. উপযোগিতার নীতি (Principle of Utility)

পাঠক্রমে এমন বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করা উচিত যা শিক্ষার্থীদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ জীবনে কাজে লাগবে। যে জ্ঞান বা দক্ষতা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা যায় না, তা শিক্ষার্থীদের কাছে অর্থহীন ও বোঝা বলে মনে হয়।

  • জীবিকা অর্জনের প্রস্তুতি: পাঠক্রমকে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। তাই এতে বৃত্তিমূলক এবং কারিগরি শিক্ষার সুযোগ থাকা প্রয়োজন, যাতে তারা পড়াশোনা শেষে কোনো না কোনো জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। মুদালিয়র কমিশন (১৯৫২-৫৩) এবং কোঠারি কমিশন (১৯৬৪-৬৬) উভয়ই পাঠক্রমে বৃত্তিমুখী শিক্ষার উপর জোর দিয়েছিল।
  • দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সংযোগ: গণিত, বিজ্ঞান, স্বাস্থ্যশিক্ষা, পরিবেশ বিদ্যা ইত্যাদি বিষয়গুলিকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে সেগুলিকে ব্যবহার করতে পারে। যেমন—ব্যাങ്കിঙের হিসাব, প্রাথমিক চিকিৎসা, পরিবেশ দূষণ রোধ ইত্যাদি।

৪. নমনীয়তার নীতি (Principle of Flexibility)

ভারত একটি বৈচিত্র্যময় দেশ। এখানকার বিভিন্ন রাজ্যের ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন। তাই একটি কঠোর, অপরিবর্তনীয় (rigid) জাতীয় পাঠক্রম সকলের জন্য উপযুক্ত হতে পারে না। পাঠক্রমকে অবশ্যই নমনীয় হতে হবে।

  • আঞ্চলিক চাহিদা পূরণ: জাতীয় স্তরে একটি মূল পাঠক্রমের (Core Curriculum) কাঠামো থাকলেও, রাজ্য বা স্থানীয় স্তরে সেই কাঠামোকে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করার সুযোগ থাকা উচিত। স্থানীয় ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি এবং উৎসবগুলিকে পাঠক্রমে স্থান দেওয়া প্রয়োজন।
  • ব্যক্তিগত আগ্রহের সুযোগ: মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়গুচ্ছ (subject combinations) থেকে নিজেদের আগ্রহ ও সামর্থ্য অনুযায়ী বিষয় বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা থাকা উচিত। NEP 2020-তে কলা, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগের মধ্যেকার কঠোর বিভাজন তুলে দিয়ে শিক্ষার্থীদের পছন্দের স্বাধীনতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, যা এই নমনীয়তার নীতির এক उत्कृष्ट উদাহরণ।

৫. সামাজিক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতির নীতি (Principle of Social Relevance / Community Linkage)

শিক্ষা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো প্রক্রিয়া নয়। বিদ্যালয় হলো সমাজেরই একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। তাই পাঠক্রমকে অবশ্যই সমাজের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে।

  • সামাজিকীকরণ: পাঠক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সামাজিক রীতিনীতি, কর্তব্য, এবং দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হবে। তারা সহযোগিতা, সহনশীলতা, এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের মতো সামাজিক গুণাবলি অর্জন করবে।
  • সমাজসেবামূলক কাজ: শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে (যেমন—স্বচ্ছতা অভিযান, বৃক্ষরোপণ, সাক্ষরতা প্রসার) অংশ নিতে উৎসাহিত করা উচিত। এর মাধ্যমে তারা সমাজের প্রতি নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়। NCF 2005 বিদ্যালয়কে সমাজের সঙ্গে যুক্ত করার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে।

৬. সমন্বয় ও অনুবন্ধের নীতি (Principle of Integration and Correlation)

জ্ঞান অখণ্ড। কিন্তু পঠন-পাঠনের সুবিধার জন্য আমরা জ্ঞানকে বিভিন্ন বিষয়ে (যেমন—ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান) ভাগ করে নিই। তবে এই বিষয়গুলির মধ্যে যে একটি অন্তর্নিহিত যোগসূত্র রয়েছে, তা শিক্ষার্থীদের বোঝানো প্রয়োজন।

  • আন্তঃবিষয়ক সংযোগ (Inter-disciplinary Approach): একটি বিষয় পড়ানোর সময় প্রয়োজন হলে অন্য বিষয়ের সঙ্গে তার সংযোগ স্থাপন করতে হবে। যেমন, ইতিহাস পড়াতে গিয়ে তৎকালীন ভৌগোলিক অবস্থা বা অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উল্লেখ করা। সিন্ধু সভ্যতা পড়ানোর সময় তার নগর পরিকল্পনা (গণিত ও বিজ্ঞান) এবং শিল্পকলা (সংস্কৃতি) নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
  • জীবনের সঙ্গে সংযোগ: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পুঁথিগত জ্ঞানের সঙ্গে বাস্তব জীবনের সংযোগ স্থাপন করা। NCF 2005-এর অন্যতম প্রধান নির্দেশিকা হলো—”connecting knowledge to life outside the school”।

৭. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকাশের নীতি (Principle of Developing Democratic Values)

ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। এই গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য ভবিষ্যৎ নাগরিকদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানো অপরিহার্য। পাঠক্রম এই দায়িত্ব পালনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

  • সাংবিধানিক মূল্যবোধ: পাঠক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, ন্যায়বিচার, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির মতো সাংবিধানিক মূল্যবোধগুলি সঞ্চারিত করতে হবে।
  • নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য: তাদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার পাশাপাশি দেশের প্রতি তাদের কর্তব্য সম্পর্কেও শিক্ষা দিতে হবে।
  • শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ: শ্রেণিকক্ষের পঠন-পাঠন প্রক্রিয়াটিও গণতান্ত্রিক হওয়া উচিত, যেখানে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে প্রশ্ন করতে পারে, আলোচনায় অংশ নিতে পারে এবং নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারে।

৮. অবসর যাপনের জন্য শিক্ষার নীতি (Principle of Education for Leisure)

আধুনিক যান্ত্রিক জীবনে অবসর সময়ের সদ্ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাঠক্রমের দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীদের এমন কিছু রুচিশীল ও সৃজনশীল কাজে প্রশিক্ষিত করা, যা তারা তাদের অবসর সময়ে আনন্দের সঙ্গে করতে পারে।

  • সৃজনশীল শখ: সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা, নাটক, বাগান করা, ফটোগ্রাফি, লেখালেখি ইত্যাদি বিষয়গুলিকে সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলি হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
  • খেলাধুলা ও শরীরচর্চা: সুস্থ শরীর ও সুস্থ মনের জন্য খেলাধুলা অপরিহার্য। এটি কেবল অবসর যাপনই নয়, দলবদ্ধভাবে কাজ করার শিক্ষাও দেয়।

৯. সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের নীতি (Principle of Conservation of Culture)

প্রতিটি দেশের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থাকে, যা তার পরিচয় বহন করে। শিক্ষার একটি অন্যতম কাজ হলো এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং তার সংরক্ষণ নিশ্চিত করা।

  • ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন: পাঠক্রমকে একদিকে যেমন দেশের মহান ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য, দর্শন ও ইতিহাসকে তুলে ধরতে হবে, তেমনই অন্যদিকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে তার সমন্বয় সাধন করতে হবে। এটি অতীতকে আঁকড়ে ধরে থাকা নয়, বরং অতীত থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

১০. দূরদৃষ্টি ও ভবিষ্যৎমুখীনতার নীতি (Principle of Forward-looking)

পাঠক্রম কেবল বর্তমানের চাহিদা মেটালেই চলবে না, তাকে ভবিষ্যৎমুখীও হতে হবে। বিশ্ব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। আজকের জ্ঞান বা প্রযুক্তি আগামীকাল পুরোনো হয়ে যেতে পারে। তাই পাঠক্রমকে ভবিষ্যৎ সমাজের জন্য উপযুক্ত নাগরিক তৈরি করতে হবে।

  • একবিংশ শতাব্দীর দক্ষতা: পাঠক্রমে সৃজনশীলতা (Creativity), সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা (Critical Thinking), সহযোগিতা (Collaboration) এবং যোগাযোগ (Communication)-এর মতো একবিংশ শতাব্দীর দক্ষতাগুলির বিকাশের উপর জোর দিতে হবে।
  • প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান শিক্ষা: দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শিক্ষাকে পাঠক্রমে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে।

ভারতীয় শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষানীতির আলোকে পাঠক্রম নির্মাণ

স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য বিভিন্ন সময়ে কমিশন ও কমিটি গঠিত হয়েছে। তাদের সুপারিশগুলি পাঠক্রম নির্মাণের নীতিগুলিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।

  • বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন (১৯৪৮-৪৯) বা রাধাকৃষ্ণণ কমিশন: এই কমিশন উচ্চশিক্ষার পাঠক্রমে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং ভারতীয় সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্তির উপর জোর দেয়।
  • মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন (১৯৫২-৫৩) বা মুদালিয়র কমিশন: এই কমিশন মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রমকে আরও বৈচিত্র্যময় ও নমনীয় করার প্রস্তাব দেয়। তারা বহুধা পাঠক্রম (Diversified Curriculum) এবং বৃত্তিমুখী শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করে।
  • কোঠারি কমিশন (১৯৬৪-৬৬): এটি ভারতের শিক্ষা ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এই কমিশন “Education for National Development” বা জাতীয় উন্নয়নের জন্য শিক্ষার কথা বলে। তাদের সুপারিশগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:
    • ১০+২+৩ শিক্ষা কাঠামোর প্রস্তাব।
    • কর্ম-অভিজ্ঞতা (Work-experience) এবং সমাজসেবাকে পাঠক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ করা।
    • বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা।
    • ত্রি-ভাষা সূত্রের (Three-Language Formula) কার্যকরী প্রয়োগ।
  • জাতীয় শিক্ষানীতি (NPE), ১৯৮৬: এই শিক্ষানীতি একটি জাতীয় কোর পাঠক্রমের (National Core Curriculum) কথা বলে, যা সারা দেশে ভারতীয় ঐতিহ্য, সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তুলবে।
  • জাতীয় পাঠক্রমের রূপরেখা (NCF), ২০০৫: এটি পাঠক্রম নির্মাণের নীতিগুলিকে একটি আধুনিক ও শিশুকেন্দ্রিক রূপ দেয়। এর প্রধান পাঁচটি পথনির্দেশক নীতি ছিল:
  1. বিদ্যালয়ের বাইরের জীবনের সঙ্গে জ্ঞানের সংযোগ ঘটানো।
  2. মুখস্থ-নির্ভর শিক্ষা থেকে সরে আসা।
  3. পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও পাঠক্রমকে সমৃদ্ধ করা।
  4. পরীক্ষা ব্যবস্থাকে আরও নমনীয় এবং শ্রেণিকক্ষের জীবনের সঙ্গে সমন্বিত করা।
  5. দেশের গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর মধ্যে থেকে শিশুদের মধ্যে যত্নশীল এক পরিচয়ের বিকাশ ঘটানো।
  • জাতীয় শিক্ষানীতি (NEP), ২০২০: বর্তমান সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী এই নীতিটি পাঠক্রম ও শিক্ষণ পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছে। এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হলো:
    • ৫+৩+৩+৪ নতুন পাঠক্রমিক কাঠামো।
    • বুনিয়াদী স্তরে সাক্ষরতা ও সংখ্যাজ্ঞানের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব (Foundational Literacy and Numeracy)।
    • কলা, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, পাঠক্রমিক ও সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলির মধ্যে কোনো কঠোর বিভাজন না রাখা।
    • ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ইন্টার্নশিপ-সহ বৃত্তিমূলক শিক্ষার সূচনা।
    • পাঠ্যবস্তুর ভার কমিয়ে মূল ধারণার (Core Concepts) উপর মনোযোগ দেওয়া এবং অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক ও অনুসন্ধান-ভিত্তিক শিক্ষাকে (Experiential and Inquiry-based learning) উৎসাহিত করা।

ভারতে পাঠক্রম নির্মাণে প্রতিবন্ধকতা বা চ্যালেঞ্জসমূহ

উপরিউক্ত নীতিগুলির উপর ভিত্তি করে একটি আদর্শ পাঠক্রম নির্মাণ করা সত্ত্বেও ভারতে তার সফল প্রয়োগের পথে বেশ কিছু বাধা রয়েছে।

  1. বিশাল বৈচিত্র্য: ভারতের ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য এত বেশি যে, একটি একক পাঠক্রমের কাঠামো দিয়ে সকলের চাহিদা পূরণ করা অত্যন্ত কঠিন।
  2. পরীক্ষাকেন্দ্রিক ব্যবস্থা: আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত পরীক্ষাকেন্দ্রিক এবং নম্বর-নির্ভর। ফলে পাঠক্রমের সৃজনশীল ও কর্মকেন্দ্রিক দিকগুলি অবহেলিত হয় এবং মুখস্থ বিদ্যার প্রবণতা বেড়ে যায়।
  3. সম্পদের অভাব: অনেক বিদ্যালয়ে উপযুক্ত শ্রেণিকক্ষ, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি, খেলার মাঠ এবং শিক্ষ উপকরণের অভাব রয়েছে। এর ফলে কর্মকেন্দ্রিক বা অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক শিক্ষা প্রদান করা সম্ভব হয় না।
  4. শিক্ষক প্রশিক্ষণের অভাব: একটি আধুনিক পাঠক্রমকে সফলভাবে প্রয়োগ করার জন্য প্রয়োজন উপযুক্তভাবে প্রশিক্ষিত শিক্ষক। কিন্তু ভারতে শিক্ষক প্রশিক্ষণের মান এবং সুযোগ এখনও পর্যাপ্ত নয়। অনেক শিক্ষকই পুরোনো পদ্ধতিতে শিক্ষাদানে অভ্যস্ত।
  5. তত্ত্ব ও প্রয়োগের মধ্যে ব্যবধান: কাগজে-কলমে বা নীতি নির্ধারণের স্তরে পাঠক্রমের ধারণাগুলি খুবই উন্নত হলেও, বাস্তব শ্রেণিকক্ষে তার প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথভাবে হয় না।


        পাঠক্রম হলো শিক্ষার হৃদপিণ্ড। একটি সুচিন্তিত, সুসংগঠিত এবং গতিশীল পাঠক্রমই একটি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারে। ভারতীয় প্রেক্ষাপটে পাঠক্রম নির্মাণের কাজটি অত্যন্ত জটিল ও দায়িত্বপূর্ণ। এখানে একদিকে যেমন দেশের মহান ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে সংরক্ষণ করতে হয়, তেমনই অন্যদিকে একবিংশ শতাব্দীর দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়।

শিশুকেন্দ্রিকতা, কর্মকেন্দ্রিকতা, উপযোগিতা, নমনীয়তা এবং সামাজিকতার মতো নীতিগুলিকে ভিত্তি করে এবং NEP 2020-র মতো আধুনিক শিক্ষানীতির নির্দেশিত পথে চলেই আমরা একটি কার্যকর পাঠক্রম তৈরি করতে পারি। তবে শুধু উৎকৃষ্ট পাঠক্রম নির্মাণ করলেই হবে না, তার সফল রূপায়ণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো, সম্পদ এবং উপযুক্তভাবে প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিশ্চিত করাও সমানভাবে জরুরি। তবেই পাঠক্রমের মাধ্যমে অর্জিত শিক্ষা শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশে সহায়ক হবে এবং ভারতকে এক উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। পাঠক্রম নির্মাণের নীতিগুলি কোনো স্থির বা জড় বস্তু নয়, বরং সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এগুলিও বিবর্তিত হয় এবং নতুন রূপ ধারণ করে। এই গতিশীলতাই পাঠক্রমকে জীবন্ত ও প্রাসঙ্গিক রাখে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *